গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না
আবার এসেছে ৩ মে। মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এটি এখন আন্তর্জাতিক একটি দিবস। ইউনেসকো এ দিনটিকে মনে করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মৌলিক নীতিমালা উদ্যাপন, বিশ্বব্যাপী প্রেস স্বাধীনতার মূল্যায়ন, তাদের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ থেকে মিডিয়াকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতা তৈরি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে
নিহত সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, তাদের হত্যাকরীদের বিচার, সকল বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেওয়া সহ মুক্তভাবে কথা বলতে দেওয়ার দাবী জানানোর মুহূর্ত।
নিহত সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, তাদের হত্যাকরীদের বিচার, সকল বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেওয়া সহ মুক্তভাবে কথা বলতে দেওয়ার দাবী জানানোর মুহূর্ত।
১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩ মেকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এদিন ঘোষণার উদ্দেশ্য হিসেবে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘দেশে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ও মুক্ত গণমাধ্যমের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ’ সেই থেকে বিশ্বের অনেক দেশে দিনটি পালন করা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে স্ব স্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এদিনটি পালন করেন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা ও গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করে এমন কিছু বেসরকারি সংস্থা।
১৯৯৩ থেকে ২০১৭ সাল। ২৪ বছর। এই সময়ের মধ্যে অনেক দেশেই গণতন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে। মুক্ত গণমাধ্যমের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায়নি।
গণতন্ত্র আর গণমাধ্যম একটি আরেকটির পরিপূরক। যেখানে গণমাধ্যম যতবেশি শক্তিশালী সেখানে গণতন্ত্রও ততবেশি শক্তিশালী। পরমত সহিষ্ণুতাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কথা। আলোচনা, মতপ্রকাশ, ঐক্য, সংহতি হলো গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সিঁড়ি। অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা গণতন্ত্রের একটি পূর্ব শর্ত। মৌলিক অধিকার হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না।
পৃথিবীর সব সভ্য সমাজ বা রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে। গণতন্ত্রিক সমাজে নগ্নভাবে, কুরুচিপূর্ণ ভাষায় পরস্পরের বিরুদ্ধে কোন বিষোদগার করা হয় না। সভ্য, ভব্য, ভদ্র ও শালীনভাবে কঠিন থেকে কঠিনতর সমালোচনাও করা হয়। কিন্তু সংস্কৃতি, সমাজ, স্বকীয়তা, জাতীয়তাবোধ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দেশ, গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে একটা সংহতি, ঐক্য ও বোঝাপড়া সবসময়ই লক্ষ্যণীয়। এধরণের সংস্কৃতি কেবল গণতান্ত্রিক সমাজেই দেখা যায়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার অভাবেই দেশে গণমাধ্যম সত্যিকারের জনমাধ্যম হতে পারছে না। দলীয়করণ, পরিবারতন্ত্র, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি গণতন্ত্র আর গণমাধ্যম কোনটাকেই শক্তিশালী হতে দেয়নি বাংলাদেশে। কী সংসদ, কী বিচারালয়, কী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কী সুশিল, কী বুদ্ধিজীবি, কী সাংবাদিক, কী আইনজীবী সবখানেই দলীয়করণ আর ব্যবসায়িক মানসিকতা! দেশের রাজনীতি আর কোন জনসেবামূলক পেশা নয় বরং লাভজনক একটি ব্যবসায় (ব্যতিক্রম, পরিবর্তনের সহায়ক শক্তির ভূমিকায় পৌঁছাতে পারছে না) পরিণত হয়েছে! তোষামদ, সুবিধাবাদিতা আর মিথ্যাচার সুবিধাভোগী সমাজকে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের সিংহভাগ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ নি:স্ব হয়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন। আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন কালোটাকার মালিক, অসৎ ব্যবসায়ী আর মুনাফালোভী ব্যবসায়ি রাজনীতিকরা। সৎ ও জনদরদী রাজনীতিক বাধ্য হয়ে রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন কিংবা ঝড়ে পড়ছেন। নির্বাচিত গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারি, ফ্যাসিষ্টদের কবলে পড়ে জনগণ অসহায়। মিডিয়া জনগণের মুখপাত্র না হয়ে সুবিধাবাদি-তল্পিবাহক দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ক্ষমতারোহন কিংবা ক্ষমতাকে পাকাপোক্তকরণের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা, হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড কেবলমাত্র একটা আইনের শাসনহীন সমাজ ও রাষ্ট্রেই চলতে পারে। গণতন্ত্রহীন সমাজে মিডিয়াও তাই আইনের শাসনের পক্ষে কিংবা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা নিতে পারে না। কোন সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক সমাজে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেই হয় খুন, নাহয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর বাইরেও আছে দুর্নীতিবাজ শাসনযন্ত্র, সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীসহ নানান অপশক্তি। এসব উপসর্গ গণতন্ত্রের বিপক্ষে কাজ করে চলেছে অবিরামভাবে। প্রকৃতঅর্থে গণতন্ত্রহীন সমাজে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাহরণ একটা স্বাভাবিক মামুলি ব্যাপার। বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম ও সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিকরা চরম ঝুঁকির মধ্য দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। বিশেষ করে আরব, আফ্রিকা ও এশিয়ায় সাংবাদিকতার ঝুঁকি বা বিপদটা সবচেয়ে ভয়াবহ। রিপোটার্স উইথআউট বর্ডার এর হিসাব মতে চলতি বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে এ পর্যন্ত ২১ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে দুইজন মার্ডার হয়েছেন বাংলাদেশে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনের সূচকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা এখনো বহুদূরের পথ। দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরাও এমনটি মনে করেন। তাঁরা এ জন্য দুর্বল গণতন্ত্রকে দায়ী করে বলেছেন, গণতন্ত্র যত বিকশিত হবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও তত বাড়বে। আজ ৩ মে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যে দেশগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ, সেই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা ২০১৫ সালের স্বাধীন গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের নম্বর ৭ পয়েন্ট কমেছে। তবে সাংবাদিকদের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক-২০১৬ তে মুক্ত গণমাধ্যমের সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে দুই ধাপ। বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪, গত বছর যা ছিল ১৪৬। সংবাদপত্র এবং মতপ্রকাশের ওপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপও এ দেশের অন্যতম মানবাধিকার সমস্যা। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিশোধমূলক হামলার ভয়ে সাংবাদিকেরা নিজেরাই সেন্সরশিপের দিকে ঝুঁকছেন। আর কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। এ রকম প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের জন্য প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ চলছে। পাশাপাশি নতুন সম্প্রচার নীতিমালা ও আইন এবং অনলাইন সংবাদপত্রের জন্য নীতিমালা করছে সরকার। কাজও এগিয়েছে অনেকটা। এই আইন ও নীতিমালাগুলো নিয়ে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে সমালোচনা আছে। কেউ বলছেন, সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অন্যদিকে সরকার বলছে, নিয়ন্ত্রণ নয় বরং গণমাধ্যমের জন্য প্রচলিত আইনগুলো যুগোপযোগী করা ও নিয়মের মধ্যে আনতে নীতিমালা করা হচ্ছে।