কাশ্মীর হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি এলাকা যেটিকে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই নিজেদের বলে দাবি করে।
একসময় জম্মু ও কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত রাজ্যটি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতের সাথে যুক্ত হয়।
ভারত ও পাকিস্তান এই অঞ্চলের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে কয়েকবার যুদ্ধে জড়ালেও শেষপর্যন্ত দুই দেশই সেখানকার ভিন্ন ভিন্ন অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।
তিন দশক ধরে ভারত শাসিত অংশে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের কারণে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
বর্তমান অবস্থা কী?
কাশ্মীরে যে কিছু একটা হতে চলেছে, অগাস্টের প্রথম কয়েকদিনে সেরকম একটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল।
ঐ অঞ্চলে ১০ হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়, হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান একটি তীর্থযাত্রার অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়, স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়, পর্যটকদের ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দী করা হয়।
অনুমান করা হচ্ছিল, ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫এ - যা ঐ রাজ্যের মানুষকে বিশেষ কিছু সুবিধা দেয় - তা বিলোপ করা হবে।
এরপর ভারত সরকারের ঘোষণা সবাইকে চমকে দেয়, যখন তারা অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রায় সম্পূর্নভাবে বিলোপের ঘোষণা দেয় যেটির একটি অংশ অনুচ্ছেদ ৩৫এ - যেটিকে গত ৭০ বছর ধরে ভারতের সাথে কাশ্মীরের জটিল সম্পর্কের মূল ভিত্তি হিসেবে মনে করা হয়।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ কতটা তাৎপর্যপূর্ণ?
এই অনুচ্ছেদটি রাজ্যটিকে বিশেষ ধরণের স্বায়ত্বশাসন ভোগ করার অধিকার দেয়, যা রাজ্যটিকে নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন তৈরি করার অনুমোদন দেয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বিষয়ক ব্যাপারের নিয়ন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
ফলস্বরুপ জম্মু ও কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখতো।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষকে জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা থেকেও বিরত রাখতে পারতো ঐ অনুচ্ছেদের বদৌলতে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সাথে যোগ দেয়া একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য ছিল কাশ্মীর; আর সংবিধানের বিধানটি ভারতের সাথে কাশ্মীরের আশঙ্কাজনক সম্পর্কের বিষয়টিরই একটি প্রতিফলন।
সরকার কেন এই অনুচ্ছেদ বিলোপ করলো?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি দীর্ঘসময় ধরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিরোধিতা করে আসছে।
ঐ অনুচ্ছেদের বিলোপ দলের ২০১৯ সালের নির্বাচনি তফসিলের অংশও ছিল।
কাশ্মীরকে একত্রিত করা এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সাথে সমতা আনার জন্য ঐ অনুচ্ছেদের বিলোপ প্রয়োজন বলে যুক্তি দিয়ে আসছিল তারা।
এপ্রিল-মে মাসে হওয়া সাধারণ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর সরকার তাদের ঐ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে একটুও দেরি করেনি।
ঐ অনুচ্ছেদ বিলোপের সমালোচকরা ভারতের অর্থনৈথিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাওয়ার সাথে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করেছেন। তাদের যুক্তি, এর ফলে সরকার একটি বিকল্প পথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার বিষয়টি থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পেরেছে।
অনেক কাশ্মীরি মনে করেন, কাশ্মীরের বাইরের মানুষকে সেখানকার জমি কেনার বৈধতা প্রদান করে বিজেপি আসলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের জনতাত্বিক বৈশিষ্ট্য বদলাতে চায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ'র সোমবারের ঘোষণা অধিকাংশ ভারতীয়কে অবাক করলেও, এত বড় মাপের একটি সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের নিশ্চিতভাবে যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হয়েছে।
কাশ্মীর ও পাকিস্তান সংক্রান্ত ইস্যুতে মি. মোদি'র অবস্থান শক্ত - এই বিষয়টি প্রচার করতে চাওয়ার অভিপ্রায়ের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি।
ভারতের সংবিধানে কাশ্মীরকে যে বিশেষ স্বায়ত্বশাসিত এলাকার মর্যাদা দিয়েছিল ৩৭০ ধারা - তা বাতিল করেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
এই ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ যোগ হয়েছিল ভারত ও কাশ্মীরের নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে। বিধানটিতে জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়া হয়, তা ছাড়া পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে কাশ্মীরের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা হয়।
কিন্তু ভারতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির নির্বাচনী ওয়াদা ছিল এটা বাতিল করা।
কীভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল এই ৩৭০ ধারা এবং কীভাবে তা বাতিল হলো - তা এক নজরে দেখে নিন নিচের এই ঘটনাক্রমে।
ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের মধ্য দিয়ে এতদিন বিশেষ মর্যাদায় থাকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাথে ভারতের বাকি অংশের জটিল সম্পর্কের ধরণটি সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়া হয়েছে।
গত সাত দশক ধরে এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে এই রাজ্যটি ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো। এবং ক্ষমতাসীন বিজেপি একেই বদলে দিতে চাইছে।
তাহলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে কাশ্মীরে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে?
ভারতের একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ কুমার মিহির বলছেন, কাশ্মীরের পুনর্গঠনের প্রস্তাবগুলো এখন সংসদের উভয় কক্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলছেন, এর আগে সংবিধানের ৩৫-এ অনুচ্ছেদের সুবাদে জম্মু ও কাশ্মীরে যারা 'স্থায়ী বাসিন্দা' ছিলেন শুধু তারাই সেখানে জমিজমার মালিক হতে পারতেন। এখন যে কেউ ঐ রাজ্যে গিয়ে জমি কিনতে পারবে।
এর আগে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য রাজ্য সরকারের চাকরিগুলো নিশ্চিত করা ছিল। এখন ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে প্রার্থীরা কাশ্মীরে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ অনুযায়ী এতদিন জম্মু ও কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়া ছিল। ভারতের সংসদের উভয় কক্ষ ভবিষ্যতে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। পররাষ্ট্র, অর্থ ও প্রতিরক্ষা বিষয়টি এতদিন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছিল। এখনও তাই থাকবে।
কুমার মিহির বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এতদিন ছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় রাজ্যটিতে কেন্দ্রের সরাসরি শাসনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যটি পরিচালনা করবেন একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর।
জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য বিধানসভা গত কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রের যেসব আইনের অনুমোদন করেছেন, সেগুলো এখন সরাসরি কার্যকর হবে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তগুলো এখন এই রাজ্যের জন্য সরাসরিভাবে প্রযোজ্য হবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ কুমার মিহির জানাচ্ছেন, এর বাইরে ভারতের দণ্ডবিধি কিংবা স্থানীয় রনবীর পিনাল কোড-এর ভবিষ্যৎ নিয়েও কেন্দ্র সরকার কিংবা সংসদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রথা থাকবে কি না, সেটার প্রশ্নেও সিদ্ধান্ত নেবে ঐ দুটি প্রতিষ্ঠান।
No comments:
Post a Comment