Header Ads

Header ADS

শবে বরাত কি? কেন বিদাআত? কুরআন হাদিসের দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্যতা কতটুকু

শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনী নিয়ে এই উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। এ রাতের ফজিলতের মহাগুরুত্ব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। তবে কোরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞানই এই পথ থেকে আমাদের মুক্তি
দিতে পারে। আর এতে মুসলিম উম্মাহর বিভাজনের রেখা অনেকাংশেই মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝেমধ্যে দেখা যায়, সঠিক কোনো প্রমাণ না থাকলেও ইবাদতের শুরুতে মুসলিম সমাজে বিদয়াত চালু হয়েছে ব্যক্তিবিশেষের দোহাই দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ কাউকে যদি বলা হয়, কেন তুমি এভাবে জিকর বা ইবাদত করছ? সে সঙ্গে সঙ্গে বলবে, অমুক অলি, অমুক পীরসাহেব, অমুক আলিম বা অমুক আকাবের করেছেন, তাই করি। সে এ কথা বলে না যে, আল্লাহ বলেছেন তাই করি, রাসুল  (সা.) বলেছেন, করেছেন বা সম্মতি দিয়েছেন, তাই করি বা অমুক সাহাবি করেছেন, তাই করি। সত্যিই এটি মহাপরিতাপের বিষয়। 
এমনিভাবে মধ্য শাবানের রজনীকে (শবে বরাত) নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু আমল মুরুব্বিদের দোহাই দিয়ে চলছে, যাতে কোরআন ও সহিহ সুন্নাহর কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

এখন শবে বরাত শব্দের বিশ্লেষণের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি দেখব, ‘শব’ শব্দটি ফারসি, যার অর্থ রাত আর ‘বরাত’ শব্দটি আরবি ‘বারাআত’ শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ বিমুক্তকরণ, সম্পর্ক ছিন্ন করা, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। সুতরাং শবে বরাত অর্থ বিমুক্তকরণ রজনী। যদিও আমাদের দেশে শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। হাদিস শরিফে উল্লিখিত ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ই ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত বলে পরিচিত। 
এখন আল কোরআনের আলোকে ‘শবে বরাত’-এর অনুসন্ধান করলে দেখব, কোরআনের কোথাও শবে বরাত বা মধ্য শাবনের রজনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উল্লেখ নেই। কিন্তু অতিরঞ্জিতকারীরা আল কোরআনের সুরা দোখানের ৩ নম্বর আয়াত দিয়ে শবে বরাত প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালান। আয়াতটি হলো, ‘ইন্না আনজালনাহু ফি লাইলাতিম মোবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরিন’, অর্থ : নিশ্চয়ই আমি এটি (আল কোরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী। অধিকাংশ আলিম বলেছেন, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’ হলো ‘লাইলাতুল কদর’।
কেউ কেউ বলেছেন, তা হলো মধ্য শাবানের রজনী। তবে এ মতটি কোরআনের দলিল দ্বারাই বাতিল হয়ে যায়। কারণ, মহান রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলেন, রামাদান মাস, যার মধ্যে আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত।
এই আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছে যে, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় রামাদান মাস আর সুরা দোখানের এই আয়াতে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’। কাজেই কেউ যদি মনে করে যে, এই লাইলাতুম মোবারাকাহ হলো রামাদান ছাড়া অন্য মাসে, তাহলে সে আল্লাহর নামে তাহা ডাহা মিথ্যা বানিয়ে বলল। 
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসিরকারক আল্লামা কুরতুবি (র.) বলেন, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ হলো লাইলাতুল কদর।’
আল্লামা ইবনে কাসির (র.) বলেন, ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে বরকতময় রাতটি শাবানের মধ্যম রজনী। এ মতটি একটি অসম্ভব ও অবাস্তব মত। কারণ, কোরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এ রাতটি রামাদানের মধ্যে। 
আল্লামা আশরাফ আলী থানবী (র.) বলেন, অধিকাংশ তাফসিরকারকই ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’কে লাইলাতুল কদর বলে তাফসির করেছেন এবং এ সম্বন্ধে হাদিসও যথেষ্ট রয়েছে। আর কেহ কেহ ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’র তাফসির করেছেন শবে বরাত। যেহেতু শবে বরাতে কোরআন নাজিল হয়েছে বলে কোনো রেওয়ায়াত নেই এবং শবে কদরে নাজিল হয়েছে বলে আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু শবে বরাত বলে লাইলাতুম মোবারাকাহ-এর তাফসির করা শুদ্ধ নয় বলে মনে হয়। 
অন্যদিকে, হাদিস জগতের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম শরিফে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান নিয়ে কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। তবে সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে এ সম্পর্কে একাধিক হাদিস পাওয়া যায়। 
যেমন—ইবনে মাজাহর ১৩৮৮ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে দণ্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ, ওই দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক তালাশকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় পর্যন্ত চলতে থাকে। হাদিসের ইমামদের মত অনুযায়ী, এই হাদিস অত্যন্ত দুর্বল।
কিন্তু বুখারি ও মুসলিম শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আমাকে ডাকার কেউ আছে কি? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে তা প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। 
বুখারি ও মুসলিমের এই হাদিস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, মুমিনের প্রতি রাতই ফজিলতপূর্ণ। অনুরূপভাবে সিহাহ সিত্তার অন্যতম হাদিসগ্রন্থ তিরমিজি শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আয়েশা সিদ্দিকা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকিতে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর অবিচার করবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করছেন। অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি ‘কালব গোত্রের মেষপালের পশমের অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন।’ 
ইমাম বুখারি (রা.) ওই হাদিসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার পরও এ হাদিসে প্রিয় নবীর এ রাতের ইবাদতের যে পদ্ধতি জানা যায়, তা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি।
প্রিয় নবী (সা.) এই রাতে ইবাদত করেছেন, তাঁর সহধর্মিণী পর্যন্ত জানেন না। তাহলে বোঝা গেল, এ রাতে কেউ যদি ইবাদত করতে চায়, তাহলে তা করতে হবে ব্যক্তিগত, একাকী, নির্জনে, নিরিবিলি পরিবেশে।
এ রাতের বিষয়ে চার ইমামের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। যেমন—ইমাম মালেক (র.) ও তাঁর অনুসারী ফকিহ ও ইমামগণ ওই রাতে বিশেষ ইবাদত পালন করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র.)-এর মতে, এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদত ও দোয়া মোনাজাতে থাকা মুস্তাহাব। ইমাম আবু হানিফা (র.) ও ইমাম আহমদ (র.) এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি। 

শবে বরাত নিয়ে ভ্রান্ত আমল ও বিশ্বাস!
আমরা পরম বিস্ময়ের সাথে দেখতে পাই শবে বরাতে আমাদের আকাশ মুহুর্মুহু আতশবাজিতে কেঁপে ওঠে। যারা বছরের হাতে গোণা কয়েক দিনের জন্যে মসজিদে আসেন, তারা ভেবে নেন, জীবনের সব গোনাহ মাফির জন্যে আজ বিশেষ বিশেষ ধরনের ইবাদত করতে হবে । কেউ কেউ এ জন্যে দুপুর রাত পর্যন্ত মসজিদে কাটিয়ে সকালের গাঢ় ঘুমের চাপে ফজরের নামাজখানাও কাযা করে ফেলেন। তারপর আবার অপেক্ষায় থাকেন পরের বছর শবে বরাতের। শবে বরাতের মূল শিক্ষা ও আমল ভুলে যাওয়ায় আমাদের সমাজে অনেক ভ্রান্ত আমল ও আকিদার সৃষ্টি হয়েছে ।
যেমন:- এক. একশত রাকাত নামাজ পড়তেই হবে কেউ কেউ এ রাতে একশত রাকাত পড়ে থাকেন। তারা এ নামাজকে বলেন, ‘সালাতুল আলফিয়া’। এই একশ’ রাকাত নামাজ পড়ার পদ্ধতিও বড় অদ্ভুত। এ নামাজে প্রতি দুই রাকাতের পরে সালাম ফেরাতে হয়। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পর দশ বার সুরা ইখলাস পাঠ করা হয়। তো একশ’ রাকাত নামাজে যেহেতু সুরা ইখলাস পাঠ হয় মোট এক হাজার বার, তাই এ নামাজকে ‘সালাতুল আলফিয়া’ বা হাজারি নামাজ বলা হয়।
ইসলামে এ ধরনের নামাজ পড়ার কোনো নিয়ম গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমে সমর্থিত নয়। রসুল স. ও তার সাহাবিগণ কখনো এ নামাজ পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ নামাজের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ইব্‌ন আবুল হামরা নামে ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের এক বাসিন্দা ৪৪৮ হিজরি বাইতুল মাকদিসে আসেন। তার কণ্ঠ সুন্দর ছিলো বিধায় মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াতের মাধ্যেমে তিনি লোকজন জড়ো করে এ নামাজের প্রচলন ঘটান। (আল মাউযুয়াত খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১২৭)

দুই. একদিনে হবে না, তিন দিন রোজা রাখা
অনেকেই এ সময় তিন দিন রোজা রেখে থাকেন। তারা ভাবেন, শবে বরাতের রোজা মোট তিনটি । একটি ১৪ শাবান শবে বরাতের আগের দিন, ১৫ শাবান একটি এবং শবে বরাতের পরদিন অর্থাৎ ১৬ শাবান একটি- এভাবে মোট তিনটি। এই তিনটি রোজা রাখার বিষয়টিও বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং রাসুলের [সা.] সুন্নাত হলো, শাবান মাসের প্রথম থেকেই বেশি বেশি নফল রোজা রাখা। আয়েশা রা. বলেন, ‘রসুল স. শবানের শুরু থেকেই এত বেশি রোজা রাখতেন, মনে হতো যেনো আর তিনি রোজা ভাঙবেন না। কিন্তু শাবানের ১৫ তারিখের পর এমনভাবে রোজা রাখা ছেড়ে দিতেন, যেনো আর তিনি রোজা রাখবেন না।’ বরং তিনি মধ্য শাবনের পরে রমজানের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান) সুতরাং বিশেষ করে তিনটি রোজা রাখা নিতান্তই অমূলক। 
তিন. শবে বরাতে ছবি ও মূর্তির খাবার তৈরি করা শবে বরাত উপলক্ষে দেখা যায়, বাজার নানা রঙের ছবি ও মূর্তি দিয়ে বানানো মিষ্টান্নতে সয়লাব হয়ে গেছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিক্রেতারা মাছের আকৃতিতে তৈরি রুটি, মযূরের মতো কাবাব ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে থাকেন। অথচ ছবি ও মূর্তি তৈরি ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না। হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি কোনো প্রাণীর প্রকৃতি তৈরি করবে, সে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে। (বুখারি ও মুসলিম) তাছাড়া এ কাজের মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া রিজিক নিয়ে নিদারুণ তামাশা করা হয়ে থাকে। যা অত্যন্ত নিন্দিত ও গর্হিত কাজ।
চার. ধারাবাহিক কবর জেয়ারত একদল মানুষ এ রাতে গোরস্থান বা মাজার জেয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাকেন। দেখা যায়, তারা এ রাতে ধারাবাহিকভাবে এলাকার সকল কবর জেয়ারত করতে থাকে। এ জন্যে তারা হাদিসের প্রমাণও উপস্থাপন করেন যে, শাবান মাসে রসুল স. জান্নাতুল বাকি কবরস্তানে জেয়ারতের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইবনে জাওযি রহ. তাদের এ বর্ণনাকে জাল আখ্যায়িত করেছেন। (আল মাউযুয়াত খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩০)
পাঁচ. আলোকসজ্জা ও আতশবাজি ব্যবস্থা করা আমাদের সমাজে দেখা যায়, শবে বরাত উপলক্ষে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। এলাকার যুবকেরা মিলে আতশবাজি ও পটকা ফুটানোর হল্লা করে। এসব কাজের মাধ্যমে অজস্র টাকা অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’ (সুরা বানি ইসরাঈল) এছাড়া এইসব কর্মকাণ্ড অগ্নিপূজকদের সাথেও বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। যা ইসলামে পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ।
ছয়. এই রাতে মৃত-আত্মার পুনর্গমনের বিশ্বাস শবে বরাত উপলক্ষে অনেক অঞ্চলের নারীদের দেখা যায়, তারা ঘর-বাড়ি পরিচ্ছন্ন করে বেশ পরিপাটি করে রাখেন এবং চারিদিকে সুগন্ধি ছিটিয়ে দেন। বিশেষ করে বিধবা নারীদের এমনটি করতে দেখা যায় বেশি। অনেকে আবার কাপড়ের পুটলিতে কিছু খাবার ঝুলিয়ে রাখেন। কারণ, তাদের বিশ্বাস, মৃত স্বামী-স্বজনদের আত্মা এ রাতে নিজ নিজ পরিবারের সাথে দেখা করতে আসে।
এই বিশ্বাস অত্যন্ত মূর্খতাপ্রসূত বিশ্বাস বৈ নয়। মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা বছরের কোনো একটি সময় আবার দুনিয়াতে ফিরে আসবে- এ বিশ্বাস ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এটা তা হিন্দুদের পুনর্জন্মের বিশ্বাসের সাথে বেশ মিলে যায়। কেউ এমন বিশ্বাস পোষণ করলে তার ঈমানের ব্যাপারে সংশয় এসে যাবে। (আত্‌তাহযীর মিনাল বিদা) আল্লাহ আমাদের সবাইকে এসকল বিশ্বাস ও আমল থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আমাদের সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে প্রচলিত কতিপয় বিদআতের উদাহরণ:
১) শবে বরাত উপলক্ষে ১৪ শাবান দিনে রোযা রাখা এবং ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ১৫ শাবানে একশত নামায আদায় করা:
এ রাতে এক অদ্ভূত পদ্ধতিতে একশত রাকাআত নামায আদায় করা হয়। যাকে বলা হয় সালাতুল আলাফিয়া। একশত রাকাআত নামায পড়ার পদ্ধতিটি হল নিম্নরূপ:
মোট একশত রাকাআত নামায পড়তে হয়। প্রতি দু রাকাত পর সালাম ফিরাতে হবে। প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর দশ বার সূরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। একশত রাকাআত নামাযে সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয় মোট এক হাজার বার। তাই এ নামাযকে সালাতে আলফিয়া বলা হয়।[1]
শবে বরাতে একশত রাকাআত নামায পড়ার বিধান:
ইসলামে এ ধরণের নামায পড়ার নিয়ম সম্পূর্ণ নতুন আবিস্কৃত বিদআত। এ ব্যাপারে সর্ব যুগের সমস্ত আলেমগণ একমত। কারণ, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীন কখনো তা পড়েন নি। তাছাড়া ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল, সুফিয়ান সাওরী, আওযাঈ, লাইস প্রমূখ যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামগণ কেউ এ ধরণের বিশেষ নামায পড়ার কথা বলেন নি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে বানোয়াট এবং জাল। যেমন, ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওযু’আত (জাল হাদীস সংগ্রহ) কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ  করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরো কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল।[2]
এ নামায কে কখন কীভাবে চালু করল?
ইমাম ত্বরতূশী (রাহ:) বলেন: শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে একশত রাকআত নামায পড়ার পদ্ধতি সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি চালু করে তার নাম হল ইব্‌ন আবুল হামরা। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের অধিবাসী। তিনি ৪৪৮ হিজরী সনে বাইতুল মাকদিসে আসেন। তার তেলাওয়াত ছিল খুব সুন্দর। তিনি শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে মসজিদুল আকসায় এসে নামায শুরু করে। আর এক লোক তার পেছনে এক্তেদা করে। অতঃপর আর একজন আসে। কিছুক্ষণপর আরে আরও একজন। এভাবে নামায শেষে দেখা গেল বিরাট জামাআতে পরিণত হয়েছে।
পরিবর্তী বছর শবে বরাতে সে ব্যক্তির সাথে প্রচুর পরিমাণ মানুষ নামাযে শরীক হয়। এভাবে এ নামাযটি মসজিদে আক্বসা সহ বিভিন্ন মসজিদে পড়া আরম্ভ হয়ে গেল। কিছু মানুষ নিজেদের বাড়িতে এ নামায পড়া শুরু করে দিল। পরিশেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যেন এটি একটি সুন্নাত।[3]
অনুরূপভাবে শুধু চৌদ্দ তারিখ দিনে রোযা রাখাও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। বরং আল্লাহর নবীর সুন্নত হল, শাবান মাসের প্রথম থেকেই বেশি বেশি নফল রোযা রাখা। বিশেষভাবে ঐ দিন রোযা রাখার কোন ভিত্তি নাই।
২) হালুয়া-রুটি খাওয়া: শবে বরাত উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে হালওয়া-রুটি খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। শুধু তাই নয় বরং সে দিন গরীব মানুষও টাকা হাওলত করে হলেও এক বেলা গোস্ত কিনে খায়। কারণ, সে দিন যদি ভাল খাবার খাওয়া যায় তাহলে নাকি সারা বছর ভাল খাবার খাওয়া যাবে। আর হালওয়া-রুটি খাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ যুদ্ধে দাঁত ভাঙ্গার পর শক্ত খাবার খেতে পারেন নি। তাই তাঁর প্রতি সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যে এ দিন ঘটা করে হালওয়া রুটি খাওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? 
প্রথমত: আমরা জানি ওহুদের এক রক্তক্ষয়ী ও অসম যুদ্ধে কাফেরদের আঘাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁত ভেঙ্গে দিয়ে ছিল। কিন্তু তা শাবান মাসে তো ওহুদ যুদ্ধ হয় নি। বরং তা হয়েছিল ৩য় হিজরী শাওয়াল মাসের সাত তারিখে। তাহলে এ সমবেদনা শাবান মাসের পনের তারিখে কি কিভাবে করা হয়?
২য়ত: হল, তিনি নরম খাবার কি শুধু একদিন খেয়ে ছিলেন? তাহলে এ কেমন ভালবাসা? আপনি শাবান মাসের পনের তারিখে কিছু  হালওয়া-রুটি খেলেন আবার কিছুক্ষণ পর গরুর গোস্ত তো ঠিকই চাবিয়ে চাবিয়ে ভক্ষণ করতে থাকেন??
৩য়ত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো কাফেরদের সাথে এক কঠিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বীরে মত যুদ্ধ করে তার পবিত্র দাঁত হারিয়েছেন কিন’ আমাদের এসব নবী ভক্তের অধিকাংশের অবস্থা হল, আল্লাহর নবীর রেখে যাওয়া সাধারণ সুন্নতগুলোও পালন করে না। অনেকে তো ফরজ নামাযই ঠিকমত আদায় করে না। এটাই হল এদের তথাকথিত ভালবাসার নুমনা।
 ৩) ছবি ও মূর্তি তৈরি: শবে বরাত উপলক্ষ্যে দেখা যায় নানা রং বেরঙ্গের ছবি ও মূর্তি তৈরি কৃত মিষ্টান্নতে বাজার ছেয়ে যায়। অথচ ছবি ও মূর্তি-প্রকৃতি ইত্যাদি তৈরি করা ইসলামে হারাম। আবার আল্লাহর দেয়া রিযিক নিয়ে এভাবে খেল-তামাশা?!
৪) মীলাদ ও যিকির: শবে বরাত উপলক্ষ্যে মসজিদ, খানকাহ ও দরগায় সমূহে শুরু হয় মীলাদ মাহফিল। চলে মিষ্টি খওয়ার ধুম। চলতে থাকে বিদআতী পন্থায় গরম যিকিরের মজলিশ। এ সব কাজ দ্বীনের মধ্যে বিদআত ছাড়া কিছু নয়।
৫) কবর যিয়ারত: এক শ্রেণীর মানুষ এ রাতে গোরস্থান বা মাযার জিয়ারতে বের হয়। এমনকি কোথাও কোথাও এ প্রথাও দেখা যায় যে, একদল মানুষ এ রাতে ধারাবাহিকভাবে এলাকার সকল কবর যিয়ারত করে থাকে। এদের দলীল হল, শাবান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাকী গোরস্থা যিয়ারতের হাদীস অথচ মুহাদ্দসিগণ উক্ত হাদীসটি জাল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। যেমনটি পূর্বে আলোচনা করেছি।
৬) আলোক সজ্জা করা এবং আতশবাজী করা : শবে বরাত উপলক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি আলোকসজ্জা করা হয়। সে রাতে আশ্চর্য জনকভাবে চলতে থাকে আতশবাজী বা পটকা ফুটানো। মূলত: এসব কাজের মাধ্যমে একদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা শুধু অপচয় করা হয় না বরং এগুলো অগ্নি পুজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
৭) মৃতদের আত্মার দুনিয়াতের পূণরাগমনের বিশ্বাস: এ উপলক্ষ্যে দেখা যায় মহিলাগণ ঘর-বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে আতর সুগন্ধি লাগিয়ে পরিপাটি করে রাখে। বিশেষ করে বিধবা মহিলাগণ এমনটি করেন। এমনকি তারা কিছু খাবার একটুকরো কাপড়ে পুরে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। কারণ, তাদের বিশ্বাস হল, তাদের মৃত স্বামী-স্বজনদের আত্মা এ রাতে ছাড়া পেয়ে নিজ নিজ পরিবারের সাথে দেখা করতে আসে। এটা যে কতবড় মূর্খতা তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।
মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা বছরের কোন একটি সময় আবার দুনিয়াতে ফিরে আসা মুসলমানদের আকীদাহ নয়। বরং অনেকটা তা হিন্দুয়ানী আকীদার সাথে সাঞ্জস্যপূর্ণ।

আহবান:
অনুগ্রহ পূর্বক এ লেখাগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে দিন, বিভিন্ন ব্লগে পোস্ট করুন এবং ফেস বুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে লিংক দিন। আপনার দ্বারা একটি মানুষ বিদআত পরিত্যাগ করলে তা আপনার জন্য মুক্তির কারণ হয়ে যেতে পারে। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
Powered by Blogger.