৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি উদযাপন করা হবে। ইতোমেধ্যে মহিলা এবং শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো দিবসটি উদযাপনের নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বছরের চাকা ঘুরে যখন ৮ মার্চ সমাগত তখন নারীদের অধিকার মর্যাদার কথাগুলো চিত্রায়িত হয় বিভিন্নভাবে।
নারী দিবসের র্যালি, আলোচনা সভা, মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও টকশোর আয়োজনসহ বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুনও পোস্টারের মাধ্যমে দিবসটি সর্ম্পকে সচেতনতা সৃষ্টির নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রতি বছর ৮ মার্চে উদযাপিত হয়এ দিবসটি।সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ্য হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারীদিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য এক এক প্রকার হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়। আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়টি গুরুত্ব পায়। বছরে একবার নারী দিবস আসলে এই কথাগুলো বিশেষভাবে উচ্চারিত হয্ মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়।
নারীবাদীদের বক্তব্য হলো ‘নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত’। বিশেষ করে ইসলাম নারীদের অধিকার খর্ব করেছে। নারীর অগ্রযাত্রায় অনেক বাধা দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে নানা প্রতিবন্ধকতা’। এসব কারণে ২০০৯ সালে নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দরকার নারী পুরুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ট’। বিগত বছরগুলোতে প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারী-পুরুষের অঙ্গীকারে গড়ে তুলি সমতার বিশ্ব শ্লোগানে ‘আমরাই পারি’, ‘অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’। ‘নারীপক্ষ’ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে ‘উৎসবে পার্বণে, নারী থাকবে সবখানে’।
মূলত এসব বুদ্ধিজীবীরা নারীর সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের ভুল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে করে প্রতারিত, অপমানিত; সমাজকে করে কলুষিত। তাই নারীবাদীদের ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে নিরীহ নারী জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নারীদের সঠিক সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা অপরিহার্য।
বক্ষমান নিবন্ধে নারী দিবস বনাম ইসলামে নারীদের আধিকার-মর্যাদা বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়াস চালানো হলো।
প্রথমে নারী দিবসের ইতিহাস প্রেক্ষাপট নিযে আলোচনা করবো।
নারী দিবসের সূচনা ১৮৫৭ সালে। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানায় বিপদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৮ মার্চে উল্লেখযোগ্য আরো ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় অন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সন্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবে ৮ মার্চকে আর্ন্তজাতিক নারী দিবস ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু করে। তখন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদযাপন করা হয়।
নারী দিবসটি বিশ্বে পালিত হচ্ছে ১৯৭৫সার থেকে। অথচ ১৫শ বছর আগেই ইসলাম নারী ও পুরুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। জাহেলি যুগে নারী জাতির কোনো মর্যাদা ছিল না। সে সময় নারীরা ছিল নিপীড়িত-নির্যাতিত ও অবহেলিত। নারীদের সঙ্গে করা হতো পশুর মতো আচরণ। পুরো নারী সত্ত্বাকে পরিবার,সমাজ ও বংশের জন্য অভিশাপ মনে করা হত। কন্যা সন্তান জন্মকে অসম্মান ও অপমানকর মনে করা হতো। শুধু কি তাই? নারীর অধিকার বলতে কিছুই ছিল না সমাজে। নারীরা যেমন মর্যাদা ও সম্মান পেতো না, ঠিক তেমনি তাদের ন্যায্য অধিকার (মিরাস) উত্তরাধিকারী পেতো না। কোন সম্পদের মালিকানাও লাভ করতে পারতো না। এমনকি একজন মানুষ হিসেবে যে অধিকারগুলো লাভ, তার কোনটিই বলতে গেলে নারীদের দেওয়া হত না। তাদের ইজ্জত-আব্রæ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছিল নৈমত্তিক ব্যাপার। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান ছিল নিম্নে। ছিল না স্বীকৃতি। বৌদ্ধ সমাজে নারীদেরকে নিছক বিলাসিতার উপকরণ মনে করা হতো। এ ধর্মে নারী হচ্ছে ভোগের বস্তু এবং মানবতার নির্মাণ লাভের জন্য বিঘœস্বরূপ। ইয়াহুদি ধর্ম মতে নারীদেরকে সকল পাপের উৎসমূল মনে করা হত।
সেই তিমিরাচ্ছন্ন কলুষিত সমাজকে নিষ্কলুষ করার জন্য বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা. সত্যের বাণী নিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরার বুকে আবির্ভূত হলেন। আল্লাহ ও তদীয় রাসুল সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হল নারীর অধিকার ও মর্যাদা। বিশ্বনবীর কল্যাণে মহিয়সী নারী মর্যাদা পেয়েছে মাতা হিসেবে। পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বামীর সংসারে স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। নারী তার বৈবাহিক জীবনে খাদ্য উপার্জনের চিন্তা হতে মুক্ত হয়েছে। তেমনিভাবে সমাজের সসর্বস্তরের নারীর যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে। নারীর মর্যাদা বলতে কী বুঝায়? মর্যাদা মানে পদ ও সম্মান। কারও পদ বা মর্যাদার অর্থ হচ্ছে যথাযথভাবে তার প্রাপ্য প্রদান করা। আর প্রাপ্য বলতে তাদের অধিকার স্বীকার করা, কর্তব্যের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানসমুহের মুল্যায়নকে বুঝায়। নারীর মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তার ন্যায্য অধিকার সঠিকভাবে আদায় করা, তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঠিক ব্যাখ্যা ও তার অবদানের যথাযথ মুল্যায়ন করা। ইসলাম মানব প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবন বিধান। এখানে মানুষকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই মানুষ হিসেবে এই মর্যাদার অংশীদার। মানবকুল নারী-পুরুষ দ্বারা গঠিত। নারী থেকে পুরুষ, পুরুষ থেকে নারী কোনভাবেই আলাদা করার সুযোগ নেই। এই পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব থাকতে হলে নারী-পুরুষের যৌথ উপস্থিতি অপরিহার্য। নারীর কাছে পুরুষ, আর পুরুষের কাছে নারী ঋণী। এই দুই এর কোন একজনকে বাদ দিয়ে মানব জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। একদিকে যেমন একজনকে ছাড়া আরেকজনের অস্তিত্বই বিপন্ন, অন্যদিকে একজনের কাছে আরেকজন অপরিহার্যভাবে ঋণী।
সুতরাং ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সব জীবনেই একজনের কাছে আরেকজন দায়বদ্ধ। মা-বাবা বিশেষ কোন দিবসের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। তারা তো প্রতিদিনের মত। মা চাঁদের আলোরমত আর বাবা সূর্যের আলোরমত দরকারী। মুসলিম সভ্যতায় পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা, মুল্যায়ন, অধিকার কোনক্রমেই কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা পুরুষের চেয়েও বেশি। স্ত্রী হিসেবে একজন নারীর জন্য ইসলাম মানবিক অধিকার নিশ্চিত করেছে । পুরুষের জন্য অপরিহার্য করা হয়েছে স্ত্রীর মোহরানা আদায় । এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, তোমরা স্ত্রীদেরকে তার পারিবারিক জীবনে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। সুরা নিসা: ৪। আল্লাহর রাসুল সা. এরশাদ করেন, যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান আছে যাদের সে লালন পালন করে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করে, তার জন্য অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব। সাহাবায়েকেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! যদি দুটি মেয়ে থাকে? নবীজী বললেন, দুটি থাকলেও। বুখারি শরিফ। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যব্যহার করতে। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছে বড় কষ্টের সঙ্গে এবং তাকে প্রসব করেছে খুব কষ্টের সঙ্গে। তাকে গর্ভধারণ করতে এবং প্রসবান্ত দুধ ছাড়াতে ত্রিশমাস সময় লেগেছে’। (আহকাফ: ১৫) নারীর মর্যাদা ইজ্জত সতীত্ব সুরক্ষার জন্য আল্লাহতায়ালা পর্দার বিধান ফরজ করেছেন। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, হে নবী! মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন পরস্ত্রী থেকে তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং নিজ যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তেমনি মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, পুরুষের থেকে তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং স্বীয় যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে। (সুরা নুর: ৩০) নারীরা পুরুষ থেকে পর্দা করবে। তার রূপ-সৌন্দর্য পরপুরুষ থেকে আবৃত রাখবে। পর্দার অর্থ এই নয় যে, নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা বরং প্রয়োজনে পর্দার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। পর্দার মাধ্যমে খাঁচার পাখির মত বন্দি করে রাখা নয় বরং নারীর ইজ্জত ও সম্মান রক্ষার জন্য ইসলামের এ বিধান। মুসলিম সমাজে সভ্যতায় মেয়ে অপেক্ষা ছেলের দায়দায়ত্বত্ব বেশি। নারী ও পুরুষ কার অধিকার বেশি? কার মর্যাদা বেশি? সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণ শেষে জবাব হবে- নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদা কোনো ক্ষেত্রে সমান, আবার কোনো ক্ষেত্রে কমবেশি। ইসলাম ঢালাওভাবে সবাইকে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয়নি। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক’। (মুসলিম) স্ত্রীদের সম্পর্কে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’। (বুখারি) মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ (তিরমিজি) শেষ কথা, শুধু বছরে একবার নারীদের প্রতি দরদী না হয়ে সারা বছর নারীদের যথাযথ প্রাপ্য আদায়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রচেষ্টা জরুরি। ইসলাম নারীকে সমধিকার নয় পুরুষের চেয়ে বেশি অধিকার প্রদান করেছে। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে তথাকথিত নারীবাদীরা নারীদেরকে ধর্ম সম্পর্কে ভুল ও ভ্রান্তিকর ব্যাখা প্রচারে লিপ্ত। কাজেই নারীবাদীদের ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে নিরীহ নারী জাতিকে মুক্ত করার লক্ষে সবাইকে সচেতন ও দায়িত্বশীল ভ’মিকা পালন করতে হবে।