স্লোগান দেয়। সেনাবাহিনী স্মৃতিসৌধেই ছাত্রদের ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন। সরকারি ফরমান জারি করে ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড অসম্ভব করে তোলা হয়। ছাত্ররা দেয়াল লিখে ও সামরিক সরকার তা মুছে দিতে থাকে। সেপ্টেম্বরে প্রথম ছাত্রনেতারা লিখিত প্রতিবাদ হিসেবে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করে।
সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান ক্ষমতায় এসেই নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই বাংলার সাথে ইংরেজী ও আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ধর্মকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাই ছিল উদ্দেশ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেসাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয় এতে। এই নীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো বলে ছাত্ররা এর প্রবল বিরোধীতা করে।১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যমত্যে পৌঁছে। ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং তারা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনমত তৈরির কাজ চালায়। এই আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুককে গ্রেফতার করলে প্রতিবাদে ছাত্ররা ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারিছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী হাতে নেয়। সেদিনই জন্ম নেয় এদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়ের।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, এদেশের ইতিহাসে একটি নিকষ কালো দিন। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারে দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত কর্মসূচীতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখল মিছিল যায় হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায়। মিছিলটি হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত দীর্ঘ হয়েছিল। মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে ও নেতারা তারের ওপর উঠে বক্তৃতা শুরু করলে পুলিশ বিনা উস্কানীতে তারের একপাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে রঙ্গিন গরম পানি ছিটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল। এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে জয়নালকে মৃত ঘোষণা করার পর আরো ফুসে উঠে ছাত্ররা। শিশু একাডেমীর এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা শিশু দিপালীও গুলিবিদ্ধ হয় এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে। সেখানে ছাত্র, শিশু ও অভিভাবকদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন, লাশের স্তূপ গড়ে ওঠে শিশু একাডেমীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ নিহত ও আহত মানুষদের এম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঢুকতে দেয়নি খুনী বাহিনী। সব লাশ গুম করে ফেলে তারা। কিছু না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার উস্কে দেয় পুলিশকে। ঐদিন নিহত হয়েছিল জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরো অনেকে।
বিকেল তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় নোয়াখালীর চাটখিল থানার দোলাইপাড় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সপ্নে বিভোর সংগ্রামী জয়নালকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছাত্র-শিক্ষক ওক্ষুব্ধ জনতার ঢল নামে। তার জানাজায় অংশ নিতে আসা হাজার হাজার মানুষের ওপর আর্মড পুলিশ, বি.ডি.আর ও মিলিটারি, রায়টকার ও শত শত সাজোয়া গাড়ি নিয়ে এসে হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে নির্বিচারে চলে গ্রেফতার, বুটের আঘাত ও লাঠি চার্জ। শিক্ষক ওঅভিভাবকরাও আক্রমন থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের কলাভবন ও উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে হাত-পা ভেঙ্গে গ্রেফতার করে ট্রাকভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে উপাচার্য পদত্যাগ করেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা খ ম জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করা হয়।
বটতলায় আক্রমণের পর জয়নালের লাশ মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে রাখা হয়, পরদিন ভোরবেলা সংগ্রামে নিয়ে যাবার জন্য। লাশের সন্ধানে পুলিশ নির্যাতন চালায় চারুকলার শিক্ষার্থীদের ওপর। পোশাকে রঙ্গীন পানির দাগ দেখে ধরে নিয়ে যায় অনেককে। সরকারীমতেই গ্রেফতার করা হয় ১,৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অধিক ছিল। তাদের শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ও ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে চালায় অকথ্য নির্যাতন। এখানেই মেরে ফেলা হয় অনেককে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশনের প্রবল চাপে পড়ে ১৫-১৬ তারিখের মধ্যেই তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার। অনেকে থাকে নিখোঁজ, যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি আজো।
১৫ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ কলেজের মোড়ে গুলি চালিয়ে দুই তরুণকে হত্যা করা হয়। সদরঘাটে এ শিশুকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়।পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের দুই ছাত্রকে ছাদ থেকে ফেলে মারা হয়। বুয়েট, ঢাকা মেডিকেলসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস থেকে গ্রেফতার করা হয় ছাত্রদের।
এই ঘটনার জোয়ার লাগে চট্টগ্রাম শহরেও। মেডিকেল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ ও গুলি চালালে নিহত হয় কাঞ্চন।
ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায় ও ছাত্র বন্দিদের মুক্তির দাবির প্রেক্ষিতে পূর্বে আটক তিন ছাত্রনেতা মুক্তি পায়। ঘরোয়া রাজনীতির অধিকার দিতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার। ১,০২১ জনকে ছেড়ে দেয় ১৭ ফেব্রুয়ারি ও আটক রাখে ৩১০ জনকে।
সেই থেকে জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরো অনেকের রক্তস্নাত এই দিনটিকে ‘স্বৈরাচার বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু আজ আমরা দেখতে পাই, এদেশের এমন একটি গৌরবজ্জ্বল দিনে ‘স্বৈরাচার বিরোধী দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন না করে 'ভালবাসা দিবস' নামক অপসংস্কৃতিতে যুবসমাজ নির্লজ্জভাবে মেতে উঠেছে। ১৯৯২ সালে বুদ্ধিবেশ্যা শফিক রেহমান এদেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র প্রচলল করে একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে সুবিধা দেবার জন্য। ভালবাসা দিবসকে সামনে রেখে চলে নোংরা ব্যবসা আর লাভবান হয় শোষক শ্রেণী। এই দিবসের নোংরা স্রোতে ভেসে যায় ঐতিহাসিক 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস'
এই গৌরবগাঁথা ইতিহাসকে ভুলে অপসংস্কৃতিত জোয়ারে গা না ভাসিয়ে, আসুন আমরা প্রকৃত ইতিহাস জানি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ইতিহাসের এই বীর আত্মত্যাগীদের।
(সংগৃহীত)