Header Ads

Header ADS

নতুন বর্ষবরণ, শুভ ইংরেজি নববর্ষ এবং ইসলামি মূল্যবোধ


কবে থেকে নতুন বছরের উসব পালন শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হাল সময়ে বিশ্বজুড়েই নববর্ষ উদযাপনের সুবিধার্থে দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। সমৃদ্ধ না হলেও ইতিহাসে দেখা যায়। আগেকার দিনে নববর্ষ উদযাপন ছিল অত্যন্ত অনাড়ম্ভরপূর্ণ ও জৌলুসহীন। ঘরোয়া পরিবেশে পরিবার-পরিজন
ও আত্মীয়স্বজনের মাঝেই নতুন বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবার আয়োজন-আপ্যায়ন এবং নতুন পোশাক পরার মধ্যে বর্ষবরণ উদযাপন সীমাবদ্ধ ছিল। কালের পরিক্রমায় বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবারের আয়োজন-আপ্যায়ন, নতুন পোশাক পরা, হিন্দুদের পূজা-অর্চনা, মুসলমানদের মিলাদ-মাহফিল-দোয়া অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে 'বর্ষবরণ' উদযাপনের উপত্তি ঘটে। 

নতুন বর্ষের বরণ শুরু হয় যেভাবে 
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষবরণ হয় দুইবার। একবার তাব বিশ্বের সাথে ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন। নিজস্ব সংস্কৃতিতে আরেকবার বৈশাখ উদযাপন। অবশ্য বৈশাখ উদযাপনটাই যেন বাঙ্গালির অবশ্য পালনীয়হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশাখ মাতাল জনৈক লেখক পহেলা বৈশাখের চিত্রাঙ্কনে লিখেছেন- শিশুরা খেলছে, বড়রা বেড়াচ্ছে, প্রেমিক-প্রেমিকারা কূজনে মগ্ন, খুশিতে, লাবণ্যে, মাধুর্যে সব পরিবেশ ঝলমল করে উঠে। ওরা না থাকলে যেন মিথ্যে হত আকাশের তারা ফোটা, মিথ্যে হত জীবনের মানে। [ নয়াদিগন্ত, ১৪ এপ্রিল, পৃঃ ৭] ইংরেজী নববর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। আমেরিকাতে হয় সবচেয়ে বড় নিউইয়ার পার্টি- যাতে ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ৮০ হাযারের মত আতশবাজি ফুটানো হয়। মেক্সিকোতে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২-টা ঘণ্টা ধ্বনি বাজানো হয়। প্রতি ঘণ্টা ধ্বনিতে ১টি করে আঙ্গুর খাওয়া হয়, আর মনে করা হয়, যে উদ্দেশ্যে আঙ্গুর খাওয়া হবে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে। ডেনমার্কে আবার কেমন লঙ্কাকান্ড! ডেনিশরা প্রতিবেশীর দরজায় কাঁচের জিনিসপত্র ছুড়তে থাকে। যার দরজায় যতবেশী কাঁচ জমা হবে, নতুন বছর তার তত ভাল যাবে। আর কোরিয়ানরা যৌবন হারানোর ভয়ে রাতে ঘুম থেকে বিরত থাকে। তাদের বিশ্বাস বছর শুরুর সময় ঘুমালে চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়। বাংলাদেশে রাত বারটা বাজার সাথে সাথে আতশবাজি, নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, উন্মত্ততা শুরু হয়। নতুন পোশাক, ভাল খাবার, বিভিন্ন স্পটে ঘুরতে যাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পালিত হয় ইংরেজী নববর্ষ। অপরদিকে বাংলাদেশে বৈশাখ বরণের চিত্রও ভয়াবহ। পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় ৩১ চৈত্র; চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তি মানে চৈত্রের শেষদিন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চৈত্রকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সূর্যাদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পিরা বিশ্বকবির বৈশাখী গান এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…’ গেয়ে সূর্যবরণের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। জানা প্রয়োজন, রমনার বটমূল পহেলা বৈশাখের ধমনী। যে গাছের ছায়ায় ছায়ানটের মঞ্চ তৈরী হয় সেটি বট গাছ নয়। অশ্বত্থ গাছ। সুতরাং বটমূল নয় অশ্বত্থমূল। বটমূল হল প্রচলিত ভুল শব্দের ব্যবহার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রাবের হয়। দেশের সমৃদ্ধি কামনায় শোভাযাত্রা বের হয় বলে এর নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। হাযার হাযার মানুষের অংশগ্রহণে মূর্তি-মুখোশ মিছিলে ঢাক-ঢোল, কাঁসা-তবলার তালে তালে চলতে থাকে সঙ্গীত-নৃত্য, উল্লাস-উন্মত্ততা। এ শোভাযাত্রায় এ বছরের শ্লোগান ছিল, ‘জাগ্রত কর, উদ্যত কর, নির্ভর কর হে। লক্ষণীয় যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গল কামনার প্রতীক হল চারুকলার ম্যাসব্যাপী পরিশ্রমে বানানো ঘোড়া, হাতি, ময়ূর, পেঁচা, পুতুল, পাখি, মূর্তি, বিভিন্ন মুখোশ প্রভৃতি। প্রিয় পাঠক! বৈশাখী অনুষ্ঠানের শুরুটাতেই হয়ত টের পেয়েছেন এটি যে সূর্যপূজা। এছাড়া বিনোদনের নামে পালনীয় কার্যক্রমেও হয়তো লক্ষ্য করেছেন হিন্দু কালচারের সফল বিচরণ। তারা বাঙ্গালী হতে গিয়ে হিন্দু রীতির লৌহ নিগঢ়ে নিজেকে জড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক হতে চাইছেন। আসলে অসাম্প্রদায়িকতাটা কি? এটি কি সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা? যদি তাই হয়, তবে বৈশাখের আহবান ধর্মনিরপেক্ষতার আহবান নয় কি? দুর্ভাগ্য হতভাগা মুসলমানদের, যারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দু সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেজেছে। 
ইংরেজি সালের বর্তমান রূপ যেভাবে এলো 
খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে এক উচ্চমান সভ্যতা ছিল। যার নাম মায়া সভ্যতা। মায়াদের সংখ্যা তাত্ত্বিক জ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা, শিল্পকলার উন্নতি ইত্যাদিতে ইতিহাস বিস্মিত। তারাই প্রথম আবিষ্কার করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। বলা হয়ে থাকে, নিজেদের গণনার সুবিধার্থে সর্বপ্রথম রোমানরা ক্যালেন্ডার তৈরী করে। তাতে বছরের প্রথম মাস ছিল মারটিয়াস। যা বর্তমানের মার্চ মাস। এটি তাদের যুদ্ধ দেবতার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। অতঃপর খৃষ্টপূর্ব ১ম শতকে জুলিয়াস সিজার কয়েক দফা পরিবর্তন ঘটান ক্যালেন্ডারে। তকালীন প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় তিনিই প্রথম ক্যালেন্ডারে (মায়াদের আবিষ্কৃত সূর্যকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ কাল) ৩৬৫ দিন ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার উদ্ভাবিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডারবাজারে প্রচলিত থাকে। বহুকাল পরে এই ক্যালেন্ডার সংশোধন করে নতুন একটি ক্যালেন্ডার চালু হয়। দুজন জোতির্বিজ্ঞানীর সাহায্যে খৃষ্টধর্মের ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরী ১৫৭৭ সালে জুলিয়াস প্রবর্তিত প্রচলিত ক্যালেন্ডারটিতে পরিবর্তন আনেন। অবশেষে ১৫৮২ সালে আরেক দফা সংষ্কার করে বর্তমান কাঠামোতে দাঁড় করান। পরিবর্তিত এ ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় জানুয়ারী দিয়ে, যা গ্রীকদের আত্মরক্ষার দেবতা জানুস’-এর নামে রাখা হয়। আমাদের ব্যবহৃত বর্তমান ইংরেজী ক্যালেন্ডারটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। প্রায় সারাবিশ্বে প্রচলিত ইংরেজী ক্যালেন্ডার এখন এটিই। 
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ইসলামি মূল্যায়ণ 
বিশেষ সময়কে উদযাপন ও সূর্যকে আহবান : ইংরেজী নববর্ষের শুরু হয় ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা ০১ মিনিটে। আর তখন থেকেই শুরু হয় আতশবাজি, বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, যুবক-যুবতীর ফ্রি স্টাইল ফূর্তি। উল্লাস আর বেলেল্লাপনায় কেটে যায় সারাটি রাত। রাতের গুরুত্বপূর্ণ যে সময়টিকে তারা টগবগে যৌবনের লাগামছাড়া নেশা মেটানোর সময় হিসাবে বেছে নিয়েছে সে সময়টিতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে আহবানকারীকে, অসুস্থকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে যা ইচ্ছা তা ডেকে ডেকে দিয়ে যান। [মুসলিম, মিশকাত হা/১২২৩।] মহান স্রষ্টার আহবানকে উপেক্ষা করে যারা শয়তানের আহবানে রাত জাগে, তাদের পরিণাম আল্লাহর কাছে কি-ই বা হবে? বাংলাদেশে ইংরেজী নববর্ষের চেয়ে বাংলা নববর্ষ অনেক বেশী সাড়ম্বরে পালিত হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটএর শিল্পীরা রমনা বটমূলে রবীন্দ্রনাথের গান এবং ধানমন্ডী রবীন্দ্র সরোবরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়ে নববর্ষের সূচনা করে। নববর্ষের শুভ কামনায় বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলা নববর্ষে সূর্যোদয়ের সময়টিকে কল্যাণের জননী হিসাবে বেছে নিয়ে সূর্যকে আহবান করা হয়। এরূপ শুভাশুভ নির্ণয় ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে রাসূল [সা.] বলেন الطِّيَرَةُ شِرْكٌকুলক্ষণে বিশ্বাস করা শিরক। [আবু দাউদ হা/৩৯১২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৩৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৫৮৪] রাসূলুল্লাহ [সা.] আরো বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ، أَوْ تُطِيَّرَ لَهُ أَوْ تَكَهَّنَ، أَوْ تُكِهِّنَ لَهُ أَوْ سَحَرَ، أَوْ سُحِرَ لَهُযে কুলক্ষণে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে বিশ্বাস করায়, যে ভাগ্য গণনা করে এবং যাকে সে ভাগ্য গণনা করে দেয়, যে জাদু করে এবং যাকে সে জাদু করে দেয়- তারা আমাদের (উম্মাতে মুহাম্মাদীর) অন্তর্ভুক্ত নয়। [সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৯৫] কোন সময়কে অশুভ বা শুভ মনে করা হিন্দু সংস্কৃতিধারী মুসলিমের কাজ। বরং বিশেষ যে সময়ের কথা হাদীছে এসেছে তা নিম্নরূপ : রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন,إِنَّ فِى اللَّيْلِ لَسَاعَةً لاَ يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ.‘রাতের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি কোন মানুষ সে সময় লাভ করতে পারে, তবে আল্লাহর নিকট ইহকাল ও পরকালের কোন কল্যাণ চাইলে আল্লাহ তাকে দান করেন। আর এ সময়টি প্রতি রাতেই রয়েছে। [মুসলিম, মিশকাত হা/১২২৪] মুসলিম জীবনে আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে- যা এক হাযার মাসের চেয়েও উত্তম’ (ক্বদর ৩)। এটিকে রামাযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিতে অনুসন্ধান করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মুসলিম জীবনে আর কোন বিশেষ মুহূর্ত নেই- যেটাকে মানুষ অনুসন্ধান করতে পারে। বস্ত্ততঃ মানব জীবনের পুরো সময়টাই হীরন্ময়। যা একবার গত হলে আর কখনো ফিরে আসে না। বরং বিশেষ সময়কে এভাবে উদযাপন করা শিরকী সংস্কৃতি বৈ কিছুই নয়। প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আবির্ভূত ইসলামকে যারা সেকেলে মনে করে, ইসলামের নবায়নের জন্য মরিয়া যারা, তারাই আবার হাযার হাযার বছরের পুরোনো সূর্য পূজাকে নিজস্ব সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে আধুনিক হওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। খৃষ্টপূর্ব ১৪ শতকে মিশরীয় অ্যাটোনিসমমতবাদে সূর্যের পূজা হত। ইন্দো-ইউরোপীয় এবং মেসো আমেরিকান সংস্কৃতিতে সূর্য পূজারীর অস্তিত্ব রয়েছে। খৃষ্টানদের ধর্মীয় উসব ২৫ ডিসেম্বর বড় দিনপালিত হয় মূলতঃ রোমক সূর্য পূজারীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুসরণে- যীশু খৃষ্টের প্রকৃত জন্ম তারিখ থেকে নয়। অথচ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত্রি-দিন, সূর্য-চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না। সিজদা কর আল্লাহকে- যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর (৪১:৩৭)। সাবার রাণী বিলকিসের এরূপ কর্মকান্ডকে তিরস্কার করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের কর্মকান্ডকে তাদের নিকট সুন্দর করেছে এবং তাদেরকে বিরত রেখেছে ফলে তারা সপথ পায়নি’ (সুরা নামল ১৪)। মূলতঃ দুই ঈদ ব্যতীত মুসলিম জীবনে আর কোন ধর্মীয় উসব নেই। এছাড়া সংস্কৃতির নামেই হোক আর ধর্মের নামেই হোক- সব ধরনের উসব পরিত্যাজ্য। বৈশাখ বরণের নামে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত গানে সম্ভাষণ জানানো, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন, মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রদর্শন- এগুলো পৌত্তলিক, সূর্যপূজারীদের ধর্মীয় আচার। এসব অনুষ্ঠান কখনো মুসলিম সংস্কৃতির অংশ নয়; হতে পারে না। কত মায়ের সন্তান যে মুশরিকত্ব বরণের উসবে আটকা পড়েছে- তা ভাবার কেউ নেই। ধর্মহীনতার চোরাবালিতে তারা তলিয়ে যাচ্ছে। আর তারা সার্বজনীন উসবের নামে একতার বাণীতে শান দিচ্ছে। মেকী ঈমানের পরহেযগার ব্যক্তিরা হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার আগে উপলব্ধি করবে কি? বাদ্য-বাজনার ব্যবহার বর্ষবরণের এসব অনুষ্ঠানে গান-বাজনা যেন পূর্বশর্ত। ঢেউ খেলানো আনন্দে বাজনা-সঙ্গীত যেন ফেনিল রাশি হয়ে বয়ে চলে। অথচ বাদ্য-বাজনার ব্যবহার ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِيْنٌএক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞভাবে অনর্থক কথা (বাদ্য-বাজনা) ক্রয় করে এবং তাকে আনন্দ-ফূর্তি হিসাবে গ্রহণ করে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (সুরা লুকমান ৩১/৬)। আববাস [রা.] থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন, إِنَّ اللهَ تعالى حَرَّمَ الْخَمْرَ وَالْمَيْسِرَ وَالْكُوبَةَ وَقال : كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌনিশ্চয়ই আল্লাহ মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন। নাফে‘ [রা.] বলেন, একদিন ইবনু ওমর [রা.] বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেয়ে দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে যান। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, নাফেতুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ [সা.]-এর সাথে ছিলাম তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম। [আবূদাঊদ হা/৪৯২৪; সনদ ছহীহ।] 
নগ্ন নারীর পুংমিশ্রণ 
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীদের অবিমিশ্রণ জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। নারী নগ্নতার এই অপসংস্কৃতি দেশকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে নিম্ন সংস্কৃতিতে। নতুন প্রজন্মের জন্য চরিত্রবান মায়ের সংকট তৈরী করছে তারা। রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন- দুই শ্রেণীর জাহান্নামী রয়েছে, যাদের আমি এখনও দেখিনি। এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে। তা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ উহার সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়।[মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫২৪।] অত্র হাদীছে আটসাঁট, অশালীন, অমার্জিত পোষাক পরিধানকারী দুর্বলচিত্ত, মাথার চুল উপরে তুলে বাধা নারীদের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাদেরকে জান্নাতহৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন, ‘আমি জান্নাত দেখলাম। লক্ষ্য করলাম তাতে অধিকাংশ অধিবাসী দরিদ্র। জাহান্নাম দেখলাম। লক্ষ্য করলাম, তাতে অধিকাংশ অধিবাসী নারী।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪] এরূপ বহু হাদীছ রয়েছে, যেগুলোতে অশালীন নারীর নিশ্চিত ক্ষতির হুঁশিয়ার করা হয়েছে। এখানে যে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, তা হল- নারী খেল-তামাসা, উল্লাস-নৃত্য করে তার যৌবন উপভোগ করার কারণে শাস্তি পাবে। তেমনিভাবে যুবকও শাস্তি পাবে। কিন্তু যে পুরুষ পরিবারের দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনি যদি পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পড়েন, তাহাজ্জুদ পড়েন, নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত হন, মুখে দাড়ি রেখে ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে চলাফেরা করেন, সমাজেও ভদ্রজন হিসাবে পরিচিতি পান, কিন্তু তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে উত্তমভাবে নজরদারি করেন না, এমনতরো ভদ্রজনকেও হাদীছে দাইয়ূসবলা হয়েছে। দাইয়ূস হলো- যে ব্যক্তি তার পরিবারকে বেহায়াপনার সুযোগ দেয়। রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন,ثَلاَثَةٌ قَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِمْ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ الْخَمْرِ وَالْعَاقُّ وَالدَّيُّوْثُ الَّذِيْ يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخَبَثَনিশ্চয়ই আল্লাহ তিন ব্যক্তির উপরে জান্নাত হারাম করেছেন; মদ্যপায়ী, পিতামাতার অবাধ্য ও দায়ূছ। যে তার পরিবারে অশ্লীলতাকে স্বীকৃতি দেয়।[ছহীহুল জামেহা/৩০৫২] দাইয়ূসী এমন একটি পাপ- যাতে নিজে পাপ করার প্রয়োজন হয় না, অন্যের পাপ দেখে নিরব থাকলেই পাপ অর্জিত হয়। তবে কোন ব্যক্তি যদি পরিবারকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, তাতে তার কোন পাপ নেই। আল্লাহ বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَاআল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)। নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণের সম্পর্কনতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি- এধরনের কোন তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পুজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখন্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোন বিশেষ তাপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরী নববর্ষ পালনের কোন প্রকার নির্দেশ দেয়া হয়নি। না কুরআনে এর কোন নির্দেশ এসেছে, না হাদীসে এর প্রতি কোন উসাহ দেয়া হয়েছে, না সাহাবীগণ এরূপ কোন উপলক্ষ পালন করেছেন। এমনকি পয়লা মুহাররামকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবীর (সা.) মৃত্যুর বহু পরে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা.) শাসন আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই, আর সেক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের কিই বা তাপর্য থাকতে পারে ইসলামে? কেউ যদি এই ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোন সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হল, অর্থা আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করল। যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ এই উপলক্ষ দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন, তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হল। আর কেউ যদি মনে করে যে নববর্ষের আগমনের এই ক্ষণটি নিজে থেকেই কোন কল্যাণের অধিকারী, তবে সে বড় শিরকে লিপ্ত হল, যা তাকে ইসলামের গন্ডীর বাইরে নিয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই শিরক এমন অপরাধ যে, শিরকের ওপর কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন: নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি। এবং যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।”(আল-মায়িদাহ, ৫:৭২) 
একটি আহবান 
মুমিন হৃদয়! কল্পনা করুন, নতুন বছরের কি মূল্য থাকবে যদি প্রাণপক্ষী পিঞ্জর ভেঙ্গে বেরিয়ে যায় পুরাতন বছরে? শুভকামনায় প্রতিটি নববর্ষ উদযাপন করে পুরাতন বছর থেকে নতুন বছর কিছুটা এগিয়েছে কি? তবে কি স্বার্থকতা রয়েছে এই উদযাপনে? সুতরাং আমাদের আহবান- আল্লাহ জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য, কে সবচেয়ে বেশী সুন্দর আমল করতে পারে (মুলক ২)। আসুন, আমরা আমলনামা সমৃদ্ধকরণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হই। যে উসব পৌত্তলিক-খৃষ্টান সমাজ গ্রহণ করেছে তাকে কেন আমরা বর্জন করছি না? রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْযে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের অনুসরণ করল, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হল।[আহমাদ, আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৪৩৪৭, সনদ হাসান] প্রিয় অভিভাবক! আপনার স্নেহের সন্তানকে যে বয়সে আপনি রশি ছেড়ে রেখেছেন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করতে, সে বয়সে মুসআব বিন উমাইর [রা.] গিয়েছেন ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হতে। তরুণ-তরুণী ভাইবোন! নিজেকে অবমূল্যায়ন করো না। তোমার মত যুবকের হাতে ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। তোমার মত তরুণীরা কত পুরুষকে দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছে। আরেকটি আবেদন রাখতে চাই- অভিভাবক মহলে, আপনার সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয় তবে আপনি ব্যর্থ অভিভাবক। জেনে রাখুন! রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, اَلاَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِতোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৮৫] সুতরাং আসুন! সেদিন আসার আগেই আমরা সচেতন হই, যেদিন আমার সন্তান আমার জান্নাতের গতিরোধ করবে। পরিশেষ পরিশেষে বলব, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ইসলামি শরীআতের সাথে সাংঘর্ষিক একটি অনুষ্ঠান। অথচ মুমিন জীবন এলাহী বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাসূলুল্লাহ [সা.]-এর যুগে পালনীয় ছিল না, এমন কিছু এ যুগেও পালনীয় হতে পারে না। কাজ করার আগেই জবাবদিহিতার চিন্তা করতে হবে। যদি ভুল করে ফেলে, তবে সে তওবা করবে। বর্ষবরণের এই অপসংস্কৃতির থাবায় পড়ে কত তরুণ-তরুণী যে জীবনের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে, তা দেখার কেউ নেই। সচেতন মুমিনদের উচিত বর্ষবরণের মতো এমন বেলেল্লাপূর্ণ এবং অর্থ ও সময়ের অপচয় সর্বস্ব অনুষ্ঠান হতে বিরত থাকা এবং সর্বস্তরের মুসলমানদের এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!                                               
Powered by Blogger.