Header Ads

Header ADS

মায়ানমারে মুসলিম গণহত্যাঃ ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার নির্বিকার বিশ্ববিবেক!

আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের বর্বর, অমানবিক ও রোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা এখন ‘টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। মানবতাবিরোধী এমন কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিবেক আজ স্তব্ধ ও হতবাক! এ যেন আধুনিক জাহেলিয়াতের আরেক নমুনা। মুসলিম নর-নারী আর শিশু-কিশোরদের
আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কাঁপছে! কিন্তু ইয়াজিদের মতো মন গলছে না এ সমাজের নব্য ফেরাউন আর নমরুদের উত্তরসূরিদের। কারণ একটাই—নির্যাতিত, বঞ্চিত আর অবহেলিত ওরা তো মানুষ নয়, ওরা মুসলমান! এখানে জাতিসংঘ, বিশ্বমানবাধিকার সংস্থা আর বিশ্ব মোড়লদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। অথচ রোহিঙ্গা আজ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ অব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আরাকান ছিল বাঙালি মুসলমানদের গড়া এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানে মগ এবং মুসলমানের মধ্যে অতীত ইতিহাসে সম্প্রীতির কোনো অভাব ছিল না। ম্রোহং (রোহাং) শহর ছিল আরাকানের রাজধানী। মহানবী (সাঃ) এর জীবিতকালেই আরবদের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরব বণিকদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরবীয় দ্বীপগুলোতে মুসলমানরা আলাদা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ রাজ্যের শাসকের উপাধি ছিল ‘সুলতান’। আরাকান মূলত ইসলামী রাষ্ট্রের আদলে গড়ে ওঠা প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি শহর। কিন্তু আজ নিজ মাটিতেই মুসলমানরা পরাধীন। কথিত আছে, এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০) মুসলমানদের কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় আরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করান। আরবীয় মুসলমানরা স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে পর রহম, রহম ধ্বনি তুলে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। বলাবাহুল্য রহম একটি আরবি শব্দ—যার অর্থ দয়া করা। কিন্তু জনগণ মনে করে, এরা রহম জাতীয় লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। এভাবেই আরাকানের গোড়াপত্তন।
বার্মার সঙ্গে আরাকানিদের সম্পর্ক সদাসর্বদা আরাকানিদের সর্বনাশ সাধন করেছে। বর্মীদের কাছে আরাকানিরা নিগৃহীত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে এবং স্বাধীনতার চেতনায় গর্বিত আরাকানিরা হারিয়েছে তাদের প্রিয় স্বাধীনতা। পক্ষান্তরে বাংলা-আরাকান সম্পর্ক আরাকানিদের জন্য এনে দিয়েছে স্বাধীনতা ও জাতিগত মর্যাদা। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান আরাকান উপকূলে অবস্থিত রামব্রী দ্বীপের অধিবাসী ‘থামাদা’ নামে জনৈক ব্যক্তি আরাকানের রাজধানী ‘ম্রোহং’য়ের ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করলে সুদীর্ঘকালের গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত স্বাধীন আরাকানের রাজনৈতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ ধক্ষংস হয়ে পড়ে। অপরদিকে বার্মার রাজাই আরাকান থেকে শিখেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি (In her previous connection with outside states, Arakan had always been gained. As feudatory to Bengal she (Arakan) had laid foundation of her age. But administered as a Governorship by the Burmese of the 18th century, she had nothing to teach a country which for centuries had been in touch with the world of thought and action through the Muslim Sultanates at a time when Burma herself was isolated and backward.)
বঙ্গদেশের করদরাজ্য হিসেবে আরাকানকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সূচিত হয় এক মহাযুগের, কিন্তু অষ্টাদশ শতকে বার্মার অধীন একটি প্রদেশ হিসেবে শাসিত হয়ে আরাকানিদের যেমন লাভ করার কিছুই ছিল না, তেমনি আরাকানিদের মতো এমন এক জাতিকে শেখানোর মতো বর্মীদেরও কিছুই ছিল না। কারণ আরাকানি জাতি কয়েক শতাব্দী ধরে জ্ঞান-গরিমার উচ্চশিখরে আরোহণকারী মুসলিম সমাজের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে ছিল। এ সময় বর্মীরা ছিল বিচ্ছিন্ন ও পশ্চাত্পদ একটি জাতি। ভোদাপায়া আরাকান দখল করে এ স্বাধীন অবস্থার বিলুপ্তি ঘটান। অথচ ঘা-থানডির সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ছিল, ভোদাপায়া আরাকানের স্বাধীন অবস্থা অক্ষুণ্ন রাখবেন আর বিনিময়ে আরাকান বার্মার রাজাকে বার্ষিক কর প্রদান করবে—যেমনটি করেছিল ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের গৌড়ের সুলতান জালালউদ্দিন শাহ। যা হোক, ভোদাপায়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে বার্মাকে একটি প্রাদেশিক রাজ্যে পরিণত করলেন এবং ঘা-থানডিকে নিয়োজিত করলেন প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে।
ভোদাপায়ার আরাকানের ক্ষমতা দখলের মাত্র এক বছরের মধ্যেই ঘা-থানডির ওপর এসে যায় আরেক প্রবল অথনৈতিক আঘাত। ভোদাপায়া শ্যাম রাজ্য (বর্তমান থাইল্যান্ড) আক্রমণের জন্য চল্লিশ হাজার সৈন্য ও চল্লিশ হাজার মুদ্রা চেয়ে ঘা-থানডির ওপর প্রজ্ঞাপন জারি করলেন। প্রকৃতপক্ষে প্রকট দারিদ্র্যের সর্বনিম্ন অবস্থানে নিপতিত আরাকানের জনগণের পক্ষে এর শতাংশ ভাগ পূরণও সম্ভব ছিল না। চাপের মুখে ঘা-থানডির দাবির অর্ধেক কোনোভাবে পূরণে রাজি হলে ভোদাপায়া রাগান্বিত হয়ে ঘা-থানডির এক ছেলেকে হত্যা করেন। পুরো দাবি আদায় না হলে পরিবারের সবাইকে অনুরূপ হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেন। এতে ভীত হয়ে ঘা-থানডি কয়েক হাজার অনুচর নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার গভীর পার্বত্য অঞ্চলে।
আর এরই সঙ্গে শুরু হয় আরাকানিদের মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রাম। অদৃষ্টের পরিহাস—যার অনুপ্রেরণায় ভোদাপায়া আরাকান দখল করলেন, তারই নেতৃত্বে মাত্র এক বছরের মধ্যে শুরু হলো একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। মূলত দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা হারিয়ে এবং আরাকানিদের ওপর বর্মী সৈন্যদের চরম নির্যাতন এবং জনগণের ওপর ভোদাপায়ার অতিরিক্ত কর আরোপ প্রভৃতিতে আরাকানের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। আরাকান থেকে লুণ্ঠিত মাল ও বিশাল মহামুনি মূর্তি দুর্গম পার্বত্য পথ দিয়ে বার্মার মান্দালয়ে স্থানান্তর করতে হাজার হাজার মগ-মুসলিম আরাকানিদের জোর করে নিয়োগ করা হয়। দুর্গম গিরিপথ দিয়ে এ স্থানান্তরের কাজ ম্রোহং থেকে মানাদলয় পর্যন্ত পথ আরাকানিদের লাশে ভরে গিয়েছিল। এখনও ম্রোহং আন গিরিপথ পর্যন্ত এলাকা জনবসতি বিরল।
সুতরাং এ কথা আজ বুঝতে বাকি নেই আরাকানের মুসলমানদেরও আজকের এ দুর্দশার মূল কারণ তারা মুসলমান। আরকানের মুসলমানদের নির্যাতনের চিত্র প্রায় শত বছরের। অথচ আজ পৃথিবীতে হিন্দু, বাৈদ্ধ, খ্রিস্টান সবার ধর্মীয় অধিকার আর স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য বহুবিধ আইন হয়েছে। শুধু নেই মুসলমানদের জন্য! খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপে ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেমন ১৬৪৮ সালের চবধপব ড়ভ ডবংঢ়যধষরধ জার্মানিতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের সমান অধিকারকে স্বীকার করে নেয় এবং এতে করে তাদের মধ্যে ৩০ বছরের যুদ্ধের অবসান হয়।
বস্তুত এর উদ্দেশ্য স্বাধীনতা নয়, ধর্মমতকে সমুন্নত রাখা। ফ্রান্স যখন হাডসন উপসাগর এবং আকাডিনকে গ্রেট ব্রিটেনের হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য ১৭১৩ সালে Utrecht (Netherlands) Treaty করে তখন তাকে বলা হয়েছিল, ওই এলাকার রোমান ক্যাথলিকরা এক বছরের মধ্যে সেখান থেকে চলে যাবে, আর যারা থাকতে চায় তারা ততটুকুই ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবে—যতটুকু গ্রেট ব্রিটেন আইনানুযায়ী তাদের প্রদান করবে। ১৭৬৩ সালে ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন এবং পর্তুগালের মধ্যে সম্পাদিত ‘প্যারিস চুক্তি’ (Treaty of Paris, ১৭৬৩) অনুযায়ী গ্রেট ব্রিটেন তার সদ্যপ্রাপ্ত কানাডিয়ান ক্যাথলিকদের ততটুকু ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ দেয়, যতটুকু গ্রেট ব্রিটেনের আইনে অনুমোদিত হয়। ভিয়েনা কংগ্রেসে ধর্মীয় স্বাধীনতার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের বিষয়টিও বিবেচিত হয়। নেদারল্যান্ডস, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রুসিয়া এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে ১৮১৫ সালের ৩১ মে ‘ভিয়েনা চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। এর ৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়, সব ধর্মীয় সম্প্রদায়কে রক্ষা করা হবে এবং ধর্ম-মত নির্বিশেষে সব নাগরিক সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করবে। সুইস ক্যান্টন বেম ও বালের (Beme and Baal) জনগণের জন্য রচিত কংগ্রেসের Final Act-এর ৭৭ অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়।
১৮শ’ শতকের শেষ দিকে যখন পোল্যান্ডের রাজা তার দেশের অর্থডক্স ও প্রটেস্ট্যান্টদের ওপর অত্যাচার করছিল তখন রাশিয়ার ক্যাথেরিন দ্বিতীয় (Catherine II) এবং প্রুসিয়া ও গ্রেট ব্রিটেনের সরকার মিলে পোল্যান্ডরাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে রাজা ওই অত্যাচার বন্ধ করতে বাধ্য হন। ১৯শ’ শতকে তুরস্কে খ্রিস্টানরা যখন বারবার চরমভাবে মার খাচ্ছিল, তখন রাশিয়ার হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি গ্রিসের মাটিতে তুর্কিদের দ্বারা খ্রিস্টান-নির্যাতন বন্ধ হয় ১৮২৯ সালে ইউরোপীয় হস্তক্ষেপে। পরের বছর ১৮৩০ সালে লন্ডন কংগ্রেস—যা গ্রিসের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, তা একটি প্রটোকল সই করে—যাতে নতুন রাষ্ট্রগুলোর ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে বলা হয়, তারা তাদের নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সম্মান করবে এবং সরকারি বা বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের সমান সুযোগ দেয়া হবে।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৮ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক মানুষের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে, সে তার ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারবে এবং প্রকাশ্যে বা গোপনে শিক্ষাদান, অনুশীলন, ধর্মানুষ্ঠান ও ধর্মপালনের মাধ্যমে তার আপন ধর্ম এবং বিশ্বাস প্রচার করতে সক্ষম হবে। নাগরিক ও রাজনৈতিক চুক্তির প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, free human being-এর আদর্শ, যে নাগরিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে এবং ভীতি ও অভাব থেকে মুক্ত থাকে, কেবল তখনই অর্জন করা সম্ভব, যখন সেই অবস্থা সৃষ্টি করা হয়—যেখানে প্রত্যেকেই তার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার উপভোগ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এসব আইন থাকলেও তা আজ মুসলমানদের জন্য একেবারেই প্রযোজ্য নয়! কিতাবে লেখা এ আইনে আরাকানের মুসলমানদের বেচে সামান্য সুরক্ষাটুকু কি দিতে ব্যর্থ?
তাছাড়া ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে নিজ ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের হাতে পরাজিত হলে শাহ সুজা সপরিবারে এবং একদল অনুচর বাহিনী নিয়ে আরাকানে পালিয়ে যান। আরাকানের তত্কালীন রাজার নাম সান্দা-থু ধর্ম্মা; রাজত্বকাল ১৬৫২-১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ। আরাকানের রাজা চন্দ্র-সু দমবর্মা বা সান্দা-থু-ধর্ম্মা শাহ সূজার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একটি বড় নৌ জাহাজ দিয়ে শাহ সুজাকে সাহায্য করবেন—যেন তিনি শেষ জীবন পবিত্র মক্কায় যাপন করতে পারেন। প্রতিজ্ঞানুসারে শাহ সুজা আরাকানের রাজধানী ম্রোহং পৌঁছলে রাজকীয় সম্মান দেখিয়ে আরাকানের রাজা তাকে গ্রহণ করেন এবং লেম্রো নদীর তীরে শাহ সুজাকে একটি সুন্দর প্রাসাদ নির্মাণ করে দেন। কিন্তু শাহ সুজার মূল্যবান সম্পদ ও অপূর্ব সুন্দরী কন্যা আমেনাকে দেখে সান্দা-সু-ধর্ম্মা পাগল হয়ে ওঠেন। যা হোক, রাজা সান্দা-সু-ধর্ম্মা রাজকুমারী আমেনাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠালে মুঘল বংশীয় শাহ সুজা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে শাহ সুজার সঙ্গে সান্দা-সু-ধর্ম্মার যুদ্ধে রোসাঙ্গের মুসলমানদের অনেক খেসারত দিতে হয়।
আরাকানিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা ভোদাপায়া আরাকান আক্রমণ করে দখল করে নিলে কয়েক হাজার আরাকানি পালিয়ে সীমান্তবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। আরাকানিরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অতর্কিত বর্মী বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। বিদ্রোহী আরাকানিদের আশ্রয়স্থল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন থাকায় বার্মার রাজা এদের মূল নেতাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্যে কোম্পানি সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। নয়তো কোম্পানির এলাকা বর্মী বাহিনী আক্রমণ করবে বলে হুশিয়ারি দেয়। একপর্যায়ে ধূর্ত ব্রিটিশ ছল-চাতুরীর সাহায্যে তিনজন বিদ্রোহী বন্দির চোখ উপড়ে ফেলে এবং জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত নিক্ষেপ করে মেরে ফেলে। ব্রিটিশদের এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ নিষ্ঠুর আচরণকে গোটা ভারত বর্বরতা বলে অভিহিত করে। এত অত্যধিক সংখ্যক আরাকানি পালিয়ে আসে যে, এ অঞ্চলে এক মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। শুধু দৈনিক শিশুর মৃত্যুর হার বিশ জন বলে এক রিপোর্টে উল্লেখ আছে। নাফ নদী আরাকানিদের মৃত দেহে ভরে ওঠে।
বর্তমান মিয়ানমারের অধীনে আরাকান প্রদেশই সেকালে রোসাঙ্গ রাজ্য হিসেবে খ্যাত ছিল। বাঙালি জাতির অনেক দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার আবেগী স্মৃতির সঙ্গে এখনও মিশে আছে রোসাঙ্গ রাজ্য ও রোসং রাজসভা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্রে এই রোসাঙ্গ রাজ্য। বাঙালি জাতির স্বকীয় ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রোসাঙ্গ রাজ্য। স্বাধীন রোসাঙ্গ রাজ্যের শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার উত্তরাধিকারী বাঙালি মুসলিম সমাজ। প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যচর্চা শুরু হয় বাংলার রাজধানী গৌড়ের ইলিয়াস শাহী রাজবংশের ঐকান্তিক আগ্রহ ও আনুকূল্যে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যকালে গৌড়ের পতনের পর আরাকানের রোসাঙ্গ রাজসভাই হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র। সপ্তদশ শতকের আরাকান রাজসভার বাঙালি কবি দৌলত কাজী, আলাওল, মরদন, নাসুল্লা খান প্রমুখ আরাকানকে রোসাঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের বৌদ্ধদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিতে থাকে। সুদীর্ঘকাল ধরে পাশবিক বর্বরতায় অভ্যস্ত জলদস্যুরা আরাকান পৌঁছলে আরাকান নানা ধরনের অপকর্মে ভরে ওঠে। বর্বরতা ও পাশবিকতায় আরাকানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়ে।
সমকালীন ঐতিহাসিক সিহাবদ্দিন তালিশ মগ দস্যুদের দস্যুবৃত্তির স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, মগ দস্যুরা জলপথে নদীর মোহনা থেকে বঙ্গদেশের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জনপদগুলোতে অতর্কিত হামলা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। স্ত্রী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ ধনী দরিদ্র যাকেই পেত অমানুষিক অত্যাচারের পর বন্দি করে নিত। বন্দিদের হাতের তালু জ্বলন্ত লৌহ শলাকা দিয়ে ছিদ্র করে ছিদ্রপথে সরু বেত চালিয়ে বেঁধে টানতে টানতে জাহাজের নিম্নতলে নিক্ষেপ করে বস্তার মতো স্তূপ করে রাখতো। সকাল-সন্ধ্যা জাহাজের উপর থেকে ছিদ্রপথে খাদ্যস্বরূপ আস্ত চাল নিক্ষেপ করত। এত পাশবিক অত্যাচারের পরও যারা বেঁচে যেত, তাদেরই তারা আরাকানে নিয়ে যেত। আরাকান রাজ এদের পতিত জমি আবাদ করে কৃষিকাজে নিয়োগ করত। অতএব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে যতবার বাংলা-বার্মা বিরোধ যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে, ততবারই আরাকান বাংলাদেশের দখলে চলে এসেছে। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, আরাকানের ওপর বর্মীদের দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করেই বর্মী সৈন্যরা সীমান্তে উসকানিমূলক তত্পরতা চালিয়েছে এবং এর পরিণতিতে বাংলা-বার্মা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনকালে বার্মার কাঠামোগত পরিবর্তন : ১৮৮৫ সালে সংঘটিত তৃতীয় এংলো-বাংলা যুদ্ধে বর্মী রাজার সর্বশেষ সেনাবাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে গোটা বার্মা ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে। উল্লেখ্য, ১৮২৪-২৬ সালের প্রথম অ্যাংলো-বাংলা যুদ্ধে আরাকান ও টেনাসারিয়াম বর্মীদের দখলমুক্ত হয়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে। ১৮৫২ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধে পেগু ব্রিটিশদের দখলে আসে। প্রকৃতপক্ষে বর্মী সৈন্যদের স্বেচ্ছাচারিতা, বর্বরতা ও বাংলা-বার্মা সীমান্তে একগুঁয়েমি আচরণ থেকে অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধের সূত্রপাত এবং এর ফলে বর্মীদের হারাতে হয় স্বাধীনতা। আরাকানে রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রধান সাক্ষী রাখাইন আর মগ সম্প্রদায়ের একটি অংশ প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে এসেছে। বার্মার সামরিক সরকার হলো এই অপপ্রচারের প্রধান হোতা ও উসকানিদাতা। দ্বিতীয়ত ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত মুসলমানদের নেতৃত্বাধীন বার্মার মুসলমানরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় বার্মার বহিরাগত মুসলমানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। একশ্রেণীর রাখাইন বা মগ অপপ্রচারকারী রোহিঙ্গা জাতির এই দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রপাগান্ডার উপাদান হিসেবে অব্যাহতভাবে কাজে লাগায়।
আরাকানের নৃশংসতম গণহত্যা : ১৯৪২ সালের জুন মাসে আরাকানের মগ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে আকিয়াব, রাছিডং, ক্যকথ, মাব্রা, মিনবিয়া, পুনাজয় প্রভৃতি এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বেপরোয়া গণহত্যার সূচনা করে। নারী শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে হত্যা, লুটতরাজ ও গ্রামের পর গ্রাম বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েও উন্মত্ত মগ হামলাকারীরা ক্ষান্ত হয়নি, বহু মানুষের মস্তক বর্শার মাথায় বিঁধে তাণ্ডব নৃত্য করেছিল। আকিয়াবের মরহুম খলিলুর রহমান বিএ. বিএল তার কারবালা-ই-আরাকান গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। আজ রোহিঙ্গাদের জন্য যেন কোনো আইনকানুন নেই। আইন যেন আজ নীরবে নিভৃতে কাঁদে। কারণ মুসলমানদের জন্য আইন নয়! আইন এখানে অকেজো, বিবেক এখানে ভোঁতা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব দৃশ্য আর মানুষের বোবা কান্না যেন মানব সভ্যতাকে ভাবিয়ে তুলছে! প্রতিটি রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নার আওয়াজ আমাদের আধুনিক সভ্যতার গালে এক-একটি চপেটাঘাত করে বলছে—হে আধুনিক পৃথিবীর মানবসমাজ! তুমি মুসলমানদের জন্য বড়ই অমানবিক। হে সভ্যতা! তুমি এখনও মুসলমানদের জন্য অনেক বর্বর। অথচ এই পৃথিবীতে মানবিকতা, ইনসাফ আর মজলুমের অধিকার আমরাই নিশ্চিত করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, আরাকানের নির্যাতিত, নিপীড়িত আর বঞ্চিত মুসলমানদের জন্য বিশ্বের ঘুমন্ত বিবেক জাগবে কবে? কবে ফিরে পাবে আরাকানের মুসলমানরা তাদের হারানো স্বাধীনতা?
Powered by Blogger.