আধুনিক বিশ্বসভ্যতায় মুসলমানদের অবদান
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থা দেখে মনে হয় তারা ধনে মানে জ্ঞানে বিজ্ঞানে গুণে
শক্তি সামর্থ্যে সকল দিকেই দরিদ্র দুর্বল ও অসহায়। শুধু তাই নয়, অন্যান্য জাতি
দ্বারা তারা চরমভাবে নির্যাতিত। পৃথিবীতে তাদের সম্মানের কোনো আসন নেই। কোনোদিকেই
তাদের অগ্রগতি ও উন্নতি নেই। মুসলিম নামক একটা
জাতি বিশ্বের মৃতের মতো পড়ে আছে নির্জীব প্রাণ।
জাতি বিশ্বের মৃতের মতো পড়ে আছে নির্জীব প্রাণ।
মুসলমানদের এমন দুর্বলহীন অবস্থায় পড়ে
থাকার তো কথা নয়। যে জাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল সারা দুনিয়াতে তারা
জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহিমা ও সভ্যতার প্রচার করবে, পৃথিবীকে তারা শাসন করবে, আল্লাহর
অসামান্য ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। আজ কেন তারা এতো অসহায় ও দুর্বল! কেন
তারা আজ এতো বেশি অত্যাচারিত ও নিগৃহীত? অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে নবী, কুরআন এ জন্য নাজিল হয়নি যে, তুমি মনমরা হয়ে থাকবে, কষ্ট
পাবে।’
আল্লাহর কালামের সত্যতার সাক্ষী
মুসলমানদের গৌরবময় অতীত। আরবের নিরক্ষর মরুচারীরা আল্লাহর কালাম ধারণ করে সত্যি
তারা পৃথিবীর শাসক হয়েছিলেন। পৃথিবীর মানুষকে তারা শিক্ষা সভ্যতা ও
জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠদান করেছিলেন। আল্লাহর অসামান্য মহিমা ও কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুনিয়ায়। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বিশ্বের শিক্ষা সভ্যতা ও
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিভাগেই তারা রেখে গেছেন অপরিসীম অবদান। এ ইতিহাস কারো
অস্বীকার করার উপায় নেই।
কুরআন কারীমে অন্যূন সাত শতাধিক আয়াতে
মহান আল্লাহ মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন ও এ সম্পর্কে গবেষণা করার নির্দেশ
দিয়েছেন। মহানবী মহাবিজ্ঞানী মুহাম্মদ (সা.) কুরআনের সমর্থক বহু মূল্যবান
পথনির্দেশ দিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে জ্ঞানের মহিমাকে উচ্চকিত করে। কুরআন মহানবী
(সা.)-এর মৌলিক নির্দেশ বুকে ধারণ করে যাযাবর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব জাতি অল্প
সময়ের মধ্যে বিশ্বসভ্যতার মশালকে নিজেদের হাতে ধারণ করলো, ফলে মধ্যযুগের সেই
অন্ধকারে জ্বলে উঠলো এক দেদীপ্যমান আলোর উৎসব। জ্ঞান গবেষণার এক পর্যায়ে তারা
জন্মদিল এক অসামান্য যুগেরÑ যা বিশ্ব সভ্যতায় আরব সভ্যতা নামে পরিচিত হলো। শিক্ষা
ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে এবং জ্ঞান গবেষণার নতুন নতুন অভিধার তালাশে মুসলিম
বিজ্ঞানী ও মনীষীরা পৃথিবীর সামনে জ্বালালেন এমনি দীপ্ত শিখা যা সেই নবম-দশম
শতাব্দী থেকে অষ্ট-ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘকাল পরিক্রমায় যুক্ত করলো এক অনন্য
মাইলফলক। আধুনিক বিজ্ঞান ও আবিষ্কার যুগের পথিকৃত হয়ে রইলেন সেই যুগ প্রবর্তক
বিজ্ঞানীগণ। আধুনিক বিজ্ঞান শুধু চমকপ্রদ আবিষ্কারের জন্যই নয়, তার নিজের
অস্তিত্বের জন্যই মুসলমানদের কাছে ঋণী।
Robert Briffault দ্ব্যর্থহীন
ভাষায় উল্লেখ করেছেন Science is the most momentaus conteibution of Arab cililization
to the madern world. The debt of our science to that of Arabs dose not cansist
in startling discscoveries or revotionary theorise, scince owes a great deal
more to the Arab culture, it owes its existence.’
মুসলিম অমুসলিম অনেক সুধীজন আছেন যারা
মধ্যযুগকে বলেন অন্ধকার যুগ। হয় অজ্ঞতা নয় হীনম্মন্যতাবশতঃ তারা একথা বলেন। ইতিহাস
সাক্ষ্য দেয়, এই সময়টা ছিল প্রকৃতপক্ষেই আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগার। আবার অনেকে সেই
বিজ্ঞানীদের বর্তমানের তুলনায় কীর্তিমানতে চান না। কিন্তু সেই যুগে সেই
পরিস্থিতিতে তা মোটেই কম কীর্তিত্বের কথা নয়। আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের সাথে
সংখ্যা গল্প যিনি আবিষ্কার করেন তার তুলনা আজ হাস্যকরও মনে হতে পারে, কিন্তু তা
ছিল কম্পিউটার আবিষ্কারের চাইতেও কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে।
মুসলিম জাতি তাদের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব
সংঘটিত করেছিল কুরআনের বলেই। এই গ্রন্থ ছিল তাদের মূল প্রাণশক্তি। বিজ্ঞানের এমন
কোনো শাখা নেই যেখানে মুসলিম মনীষীদের হাতের ছোঁয়া লাগেনি। তাঁদের কালজয়ী
গ্রন্থগুলো শত শত বছর ধরে ইউরোপে পাঠ্য ছিল। ইবনে সীনা, আলরাজী, আবুল কাসেম
জাহারাভী ইবনুল হাইছাম, জারকালী, জাবির ইবনে হাইয়ান, মূসা আল খারেজমী, ইবনে নাফিস
প্রমুখ বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও রচনাবলী সেইদিনও ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে
মূল পাঠ্য ছিল। ইবনে সিনার ‘কানুন’ ছয় শত বছর এখানেই পঠিত হয়।
এভাবে বহু প্রামাণ্য তথ্যের উল্লেখ করা
যায়, যাতে আধুনিক ইউরোপ এ সকল বিজ্ঞানীদের প্রতি প্রণত হয়েছেন ও খোলাখুলি
স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আবার মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কারকে আত্মস্থ করতেও
কুণ্ঠিত হয়নি পাশ্চাত্য। তারা এসব পুরোধা মাহাত্মদের নাম বিকৃত করেছেন নিজেদের নাম
তাতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন নানা কূটকৌশলে। অসংখ্য মুসলিম মনীষীদের নাম ও রচনাবলী পৃথিবী
থেকে হারিয়ে গেছে। রাষ্ট্র হাত বদলের জিঘাংসায় মুসলিম কীর্তির বেশিরভাগ নির্দেশনাই
নষ্ট করে দিয়েছে বর্বর ইউরোপীয়রা। নদীতে নিক্ষেপ করে, পুতে, রান্নার কাজে তারা
ধ্বংস করেছ অনেক অমূল্য সম্পদ। তারা জানতো না সেদিন তারা কি ক্ষতি করেছিল। ১৬শ’ শতাব্দীতে খ্রিস্টান বিজ্ঞানী রামুস মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাজারে
ইবনুল হাইছামের একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। একদিন পুরনো এক বইয়ের দোকানে
ধূলিকালিমা ছেঁড়া ঐ পাণ্ডুলিপি পেয়ে তিনি এমন আনন্দিত হন, যেনো সাত রাজার ধন হাতে
পেয়েছেন।
বিজ্ঞান জগতে মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠ যুগ
চিহ্নিত হয় সাধারণত ৭৫০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দে- এই সাড়ে তিনশত বছর। অথচ এই
উত্তরাধিকার কাজে লাগাতে ইউরোপকে ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।
পৃথিবীর কোনো সভ্যতাই চিরস্থায়ী নয়। এই দিক দিয়ে ইউরোপ এতো দেরিতে কেন আরব জাতির
শ্রেষ্ঠ সম্পদ পেলো। কারণ ইউরোপে একমাত্র স্পেন ছাড়া অন্য কোনো স্থানে মুসলিম শাসন
প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। স্পেনেও যদি মুসলমানরা ঢুকতে না পারতো তা হলে নিশ্চিত
আধুনিক সভ্যতা আরো কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে যেত।
শিক্ষায় মুসলমানদের অবদান
দুনিয়ার শিক্ষা বিপ্লবের ইতিহাসে ইসলাম এ
কারণে নিজের গৌরব প্রকাশ করতে পারে যে, যেহেতু আল কুরআনে নাজিলকৃত সর্বপ্রথম পাঁচ
আয়াতের প্রথম শব্দটি হচ্ছেÑ ‘ইকরা’ পাঠ করো-পড়ো। পাঠ পঠন লিখন ইত্যাদি দিয়েই পবিত্র ইসলামের হাতেখড়ি
হয়। শুধু তাই না, ইসলামের মূল ভাষ্যকার বিশ্ব সভ্যতা ও মুক্তির বুনিয়াদী দলিল আল
কুরআনের শাব্দিক অর্থ হচ্ছেÑ পাঠ, আবৃত্তি। কুরআন শিক্ষা সমন্বয় এমন এক প্রভাব
দায়ী জাদুকরী গ্রন্থ যা সবেমাত্র দু’ দশক যেতে না
যেতেই একটা বৃহৎ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করে ফেলে। অথচ তখনকার গোটা আরবে ১৮/১৯ জনের
বেশি শিক্ষিত লোক ছিল না। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে কাব্য সাহিত্য চর্চা ও
শিক্ষার সমাদর ছিল আরবে খুব বেশি। রাসূল (সা.) প্রত্যেক সাহাবীকে একজন শিক্ষকরূপে
গড়ে তুলেছিলেন। হজরত ওমর, আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস,
আব্দুল্লাহ বিন ওমর, যায়িদ বিন সাবিত ও হজরত আয়েশা (রা.) ছিলেন প্রথম কাতারের
সুবিজ্ঞ ও পণ্ডিত। হজরত আলী (রা.) একজন অসাধারণ পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী ছিলেন।
তিনি নিজেই দর্শন, ইতিহাস, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, হাদীস, কাব্য ইত্যাদির উপর
সাপ্তাহিক মজলিশে বক্তৃতা দিতেন। তাঁর আমলে রাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষানগরীগুলোর
ঔজ্জ্বল্য দেদীপ্যমান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাগণ জ্ঞান ও
শিক্ষাবিস্তারে খুবই মনোযোগী ছিলেন। ফলে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক
যুগের অধ্যায় সূচিত হয়। আব্বাসীয় যুগকে তাই ইসলামের ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। ইউরোপে ইসলাম প্রবেশ করে
৭১২ সালে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এটিই সারা বিশ্বের শিক্ষা
শিল্প সভ্যতা ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। গোটা ইউরোপ ও আফ্রিকায়
স্পেন Seat of learning নামে খ্যাতি লাভ করে। কর্ডোভা, সেভিল, টলেডো, জেইন ও
মালাগার উচ্চ শিক্ষায়তনগুলোর ভিড় জমাতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালী হতে আসতো
শিক্ষার্থীরা। স্পেনে যখন প্রায় প্রত্যেকেই লেখাপড়া জানতো তখন খ্রিস্টান ইউরোপে
গুঁটিকয়েক পুরোহিত ব্যতীত অন্যরা ছিল নিরেট মূর্খ।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অনেকগুলো
শতাব্দী অতিবাহিত হয়েছিল। মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয় (৭১২ খ্রি.) থেকে শুরু
করে সিরাজউদ্দৌলার পতন (১৭৫৭) পর্যন্ত বিভিন্নভাবে মুসলিম প্রভাব ও প্রশাসন ভারতে
কায়েম ছিল। ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে মুসলমানরা নতুন যুগের সূচনা করে। মুসলিম পূর্ব
ভারতে গুঁটিকতেক ব্রাহ্মণের ভেতরে শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষা যে শুধু কুলীন
সমাজের জন্য নয়, সাধারণের সমান অধিকার আছে, এই বিরাট পরিবর্তন ভারতে মুসলিম আমলেই
প্রতিষ্ঠিত হয়।
মোঘল আমল ছিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির এক
সূবর্ণ অধ্যায়। এস এম জাফর তাঁর Education
in Muslim India গ্রন্থে লিখেন : মোঘল সাম্রাজ্যের দুশ’ বছরে কলা সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে
সর্বাঙ্গীন উন্নতি হয়েছিল, তা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে সম্ভব হয়নি।
স্বাভাবিকভাবেই, এই বিরাট অগ্রগতির পেছনে প্রেরণা যুগিয়েছিল শিক্ষা, যা সেদিনের
মোঘল সম্রাটদের প্রচেষ্টার ফল। এটি তাঁদের শিক্ষানুরাগেরই প্রমাণ।’ শিক্ষার উন্নয়নে মুসলমানরা যে নতুন যুগের সূচনা করেছে তা তাঁদের
উপায় উপকরণের মধ্যে প্রকাশিত। মুসলমানরাই সর্বপ্রথম দশম শতাব্দীতেই সমরকন্দ থেকে
ভারতবর্ষে কাগজ আমদানি করে।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার
খলজীর বাংলা অধিকারের পর হতে মূলতঃ বাংলার শিক্ষার স্বর্ণযুগ আরম্ভ হয়। ব্যক্তিগত
প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
১২০০ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয়
শত বছরের দীর্ঘ শাসনকাল ছিল বাংলার শিক্ষার এক স্বর্ণোজ্জ্বল যুগ। এই সময়কালে
আরব, আফগান, তুর্কি, মোঘল, পারসিক প্রভৃতি বংশীয় প্রায় ৭৬ জন মুসলিম শাসক বাংলা
শাসন করেন। এই সময়কালে শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রধানত দু’টি অবদান রেখেছিল। একটি শাসক শ্রেণী এবং অন্যটি আলিম ও
সূফী সাধকগণ।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আরব উপদ্বীপের
লোহিত সাগর হতে নীলনদ, স্পেনের জিব্রাল্টার হতে বঙ্গোপসাগরের ঢেউমালা পর্যন্ত
বিস্তৃত মুসলিম শিক্ষার যে সার কথা বর্ণিত হলো তাতে এ কথা স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত হয়ে
যায় যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম অবদান পৃথিবীতে এক স্থায়ী আবেদন সৃষ্টি করে। মুসলিম
সভ্যতার স্বর্ণফসল তারই প্রমাণ বহন করে যুগ যুগ ধরে।
রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে মুসলমান
ইসলামের প্রথমদিকেই রসায়ন নিয়ে
আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। মহানবী (সা.) ওষুধ নিয়ে নানা বক্তব্য রেখেছেন। হাদীস
গ্রন্থগুলোতে ‘তিরবুন নবী’ শীর্ষক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। তাই ওষুধকে যদি রসায়নের পর্যায়ে
ফেলা যায় তা হলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের প্রথম রসায়নিক। এরপর চতুর্থ খলিফা
হজরত আলীর নাম উল্লেখ করা যায়। রসায়ন সম্পর্কে তাঁর বাণী আরবী সাহিত্যে অমরত্ব লাভ
করেছে।
হজরত আলীর সোনা তৈরির রসায়নিক পরিকল্পনার
উত্তরাধিকার বহন করেন হজরত মুয়াবিয়ার পৌত্র খালেদ বিন ইয়াজিদ। উমাইয়া যুগের বিরল
বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম গ্রীক বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসমূহের অনেকগুলো আরবীতে
অনুবাদ করেন। কিহরস্তের মতে, ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম অন্য ভাষা থেকে
আরবীতে গ্রন্থ রচনা করেন। আলরাজী, আবুল কাশেম প্রমুখ পরবর্তীতে খ্যাত রসায়নবিদ
তাঁদের রচনায় খালেদের নাম ও মতবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
মহানবীর অধস্তন পুরুষ, শিয়াদের দ্বাদশ
ইমামের ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল সাদিক (জন্ম ৬৯৯, মতান্তরে ৭০২ খ্রি.) এর নাম পরবর্তী
রসায়নবিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও তিনি রসায়ন বিজ্ঞানের জনক জাবির ইবনে
হাইয়ানের ওস্তাদ ছিলেন। ইবনে খাল্লিকানের মতে, জাবির ইবনে হাইয়ান ২ হাজার পৃষ্ঠার
যে গ্রন্থ রচনা করেন তাতে তাঁর শিক্ষক জাফরের আবিষ্কৃত সমস্যাগুলোও সন্নিবেশ করেন
এবং এতে গ্রন্থের ৫০০ পৃষ্ঠা ব্যয় হয়। জাবির ইবনে হাইয়ানকে পৃথিবীর সর্বপ্রথম
রসায়ন বৈজ্ঞানিক বলা হয়। রসায়ন বিষয়ক রচনা জাবির ইবনে হাইয়ানকে চির অমর করে
রেখেছে।
জাবির তাঁর কিতাব ‘ইলমের সানতিল ইয়াহিয়া ওয়াল হিকমাতিল কালাসিফা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : রসায়ন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি
শাখা। এতে দ্রবনীয় বস্তু বা ধাতু সমূহের গঠন প্রণালী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা হয়
এবং খনিতে কিভাবে আগুনের সাহায্যে ধাতু উৎপন্ন হয় সে সম্পর্কেও অনুসন্ধান চালানো
হয়। কেননা কৃত্রিম উপায়ে এ সমস্ত তৈরি করতে মানুষকে প্রাকৃতিক নিয়মই অনুসরণ করতে
হবে। যারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে অভিজ্ঞ তারা জানেন যে, রসায়ন বিজ্ঞান
প্রকৃতিরই অনুসরণ এবং সেই অনুসারেই গড়ে উঠে।
পদার্থ বিজ্ঞানের আওতায় কুরআনে অনেক
কৌতূহলোদ্দীপক অনেক বর্ণনা রয়েছে। নিম্নোক্ত আয়াতটি এ বিষয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বলা হয়েছে, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উপমা যেনো একটি
দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত,
কাঁচের কাঠামোসহ প্রদীপটি উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রসদৃশ্য, ইহা পুত পবিত্র করা হয়,
যয়তুন বৃক্ষের তেল দ্বারা যাহা প্রাচ্যের নয়, প্রতিচ্যেরও নয়, অগ্নি উহাকে স্পর্শ
না করলেও যেনো উহার তেল উজ্জ্বল আলো দিতেছে, জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে
ইচ্ছে পথ প্রদর্শন করেন, তাঁর জ্যোতির দিকে। আল্লাহ মানব জাতির জন্য উপমা সন্নিবেশ
করে থাকেন এবং তিনি সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (২৪:৩৫)
এই আয়াত প্রাকৃতিক দর্শন ও জড়
বিশ্বের প্রেরণার উৎস। আয়াতটি মরমী দর্শনের কথা বাদ দিলেও আয়াতটি বিজ্ঞানের
অনুসন্ধানকারীদের জন্য নানা পার্থিব বিষয় যেমন আলো, প্রদীপ, কাঁচ, উজ্জ্বল নক্ষত্র
ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য আছে। এ অনুপ্রেরণার ফলেই দেখা যায় পদার্থ বিজ্ঞানের আলোর
শাখায় মুসলমানদের বিরাট অবদান। আলোক বিজ্ঞান, বর্ণালী, প্রতিবিম্বন, প্রতিসরণসহ
আলোর নানা বিষয়ে গবেষণায় তাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন। ফিন্দি, হাইছাম ও
লাইরেজী প্রমুখের আলোক বিজ্ঞান গবেষণা এ স্বীকৃতির পরিচয় বহন করে। আলোর গতি
সম্পর্কীয় আয়াতে যে ধারণা দেয়া হয়েছে তাতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষিত
হয়েছে।
ইবনুল হাই পদার্থ বিজ্ঞান আলোচনায় যে
বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তা আধুনিক বিজ্ঞানীদের বিস্ময়াভিভূত করেছে। এ
সম্পর্কিত তাঁর প্রস্তাবিত সমস্যাসমূহ ও সমাধান এই বিংশ শতাব্দীতেও বিজ্ঞানীরা horrible prolik বলে অভিহিত করেছেন। বর্তমান কালের নামজাদা বিজ্ঞানী J F Allem এর বক্তব্যে Al Hezan could be Said to have a 20th eantury mind
in a 10th cuntury Setting. পদার্থ বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ইবনুল হাইছামের অবদান আছে, তবে ‘আলো’র বিষয় অবদানই তাঁকে বর্তমান বিজ্ঞান
জগতে স্মরণীয় করে রেখেছে। এমনি আরো অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান রয়েছে পদার্থ
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। আজ মধ্যযুগকে তথা আরব সভ্যতার যুগকে অন্ধকার যুগ বলে
যারা চিহ্নিত করতে চান তারা পেঁচার চোখ বুজে থাকার মতোই।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমান
পবিত্র কুরআনে বিজ্ঞান সাধনার জন্য
অসংখ্যবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি সম্পর্কে বিশেষ করে পৃথিবী,
নভোমণ্ডল, দিনরাত বিবর্তন, মহাশূন্য, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগত, মানবদেহ ইত্যাদি
সম্পর্কে বহুবার চিন্তাশীল লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সকল
ভিত্তি কুরআনের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। বিশ শতকে এসে বিজ্ঞানের নতুন কোনো আবিষ্কার
কুরআনের কোনো বৈজ্ঞানিক থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করতে পারেনি। অনেক পণ্ডিত এ নিয়ে
গবেষণা করেছেন। প্রসঙ্গত ফরাসী বিজ্ঞানী কৃত বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান গ্রন্থটির কথা
বলা যায়। Hartwung
Herschfeld ১৯০৬ সালে প্রকাশিত তাঁরÑ New Researches in to the Composition and Exegeris of the Quran’ গ্রন্থে চমৎকারভাবে বলেছেন : We must not be surprised to find the Quran regarded as the
Foundain head of the all Sciance. Every Subjcet connected with haaven or earth,
human life, Commerce and various trades are oceasionally to uched upon and this
gave rise to the produetion of numerous monographs formong commentaries on
parts of the book, In this way the Quran was responsible for great discussions,
and to it was also indirectly due the marvellaus develoment of all branches of
scince in the Muslim world.
মহানবীর (সা.) চিকিৎসা বিধান
হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে ‘তিব্বুন নবী’ শীর্ষক ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। এই
হাদীসগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় অধিকাংশই রোগ নিরাময়ের জন্য নিবারণের ব্যবস্থা
খুবই কম। তা সত্ত্বেও চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বিশ্বনবী (সা.) যে গুরুত্ব প্রদান করেছেন
তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছে। Prof.
Brown বলেছেন, নবী (সা.) চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর মধ্যে ভাষ্য Prophet Muhammad is a traditions Familiar to all
Muslims is said to have linked medicine try importance with theology.’
প্রকৃত পক্ষে ৭ম শতাব্দীতে মুসলিম
চিকিৎসকগণের মূল অভিযাত্রা শুরু হয়। আরবের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তারের পটভূমিতে
মুসলিম দুনিয়ার যে বহুমুখী জ্ঞানবত্তার উন্নতি দেখা দেয় তা ইসলামী
সভ্যতার ইতিহাসকে মহিমাময় করেছে। ৮ম শতকে মুসলিম রসায়নবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান
এর আগমনে মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন তৎপরতা দেখা দেয়। চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে
তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। ইবনে নাদিমের মতে, তিনি এ শাস্ত্র সম্পর্কে ৫০০টি পুস্তক
রচনা করেন। আবুল হাসান আহমদ আততাবারী একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। তিনি চোখের
চিকিৎসা সম্পর্কে লিখেছেন। তাঁর গ্রন্থÑ ‘মুয়ালাজাতুল
তুকরাতিয়া’ হিপপোক্রেটের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে।
পাশ্চাত্যে রাজেস (Rhazes) নামে পরিচিত আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর রাজী নবম
শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়। শুধু তাই নয়, তিনি চিরকালের এক মহান
বিজ্ঞানী। তিনি মোট ৩৫ বছর চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান
সম্পর্কে ১১৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। আল রাজীর ‘কিতাবুল হাবী’ সর্ব বৃহৎ গ্রন্থ। এটি ৩০ খণ্ডে সমাপ্ত। পৃথিবীর পুরাকালের
চিকিৎসা ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
আবু আলী আল-হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ ইবনে
সীনা (৯৮০-১০৩৭) পাশ্চাত্যে Avicena নামে পরিচিত। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চিকিৎসক
হিসেবে কর্মজীবনের শুরু করেন এবং বুখারার সামানীয় সুলতান নুহ বিন মুনসরের
(৯৭৬-৯৯৭) ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত হন। চিকিৎসা বিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান
চিকিৎসা বিশ্ব কোষ ‘আল কানুন ফিত তীব’। এছাড়া এ বিষয়ে তিনি আরো ১৫টি পুস্তক রচনা করেন।
সর্বশ্রেষ্ঠ আরব ফার্মাকোলিস্ট ছিলেন ১৩
শতকের বিখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী (Botanist) ইবনুল বাইতার।
মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষেও অসংখ্য
হাসপাতাল ছিল। এসব চিকিৎসালয়েও সব রকমের সুবিধা ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জামাদি
মওজুদ থাকতো।
সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদ জঙ্গি ছিলেন
মুসলিম শাসকদের মধ্যে কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি দামিকাক নগরীতে এক বিশাল
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এ হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসা হতো। তিনি হাসপাতালে একটি
চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে বিশেষ যতেœর সাথে চিকিৎসা বিদ্যার
বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়ানো হতো। বাগদাদ নগরীতে এক জাকজমকপূর্ণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা
করেন খলিফা আফদুদ্দৌলাহ। কায়রো নগরীতে প্রতিষ্ঠিত মিসরের ‘মানসুর কালাউন’ হাসপাতাল ছিল বিখ্যাত। এভাবে
ইসলামের স্বর্ণযুগে প্রতিটি শহর ও লোকালয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক
হাসপাতাল ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তখন ভ্রাম্যমাণ চিকৎিসা
পদ্ধতি চালু ছিল।
প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান
বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্রান্তিকালেই ঘটেছিল
ইসলামের আবির্ভাব। প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধুঁকে মরছিল। বিজ্ঞানী পুড়িয়ে মার হচ্ছিলো
ধর্মবিরোধী অপবাদ দিয়ে। দেশান্তর করা হচ্ছিলো গ্রীক বিজ্ঞান আলোচকদের। ইসলামের
আবির্ভাবের ফলে মানব জাতি সাথে সাথে বিজ্ঞান জগত ও যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
অনতিকালের মধ্যেই প্রাচীন বিজ্ঞানের উদ্ধার ও চর্চা শুরু করে দিলো মুসলিম দুনিয়া।
কুরআনে করীমে হজরত সুলাইমান (আ.) এর যেসব কার্যকলাপের বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে অনেক
প্রযুক্তিগত চিন্তার খোরাক রয়েছে। বাইবেলেও এর স্বীকৃতি পাওয়া যায়। বলা হয়েছে,
তিনি লৌহ এবং তামা গলিয়ে নানা জিনিস তৈরি করতেন। দাউদ (আ.) লোহা গলিয়ে বর্ম তৈরি
করতেন। লোহার গলন তাপ ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড আর উবালন তাপ ৩০০০ ডিগ্রি
সেন্টিগ্রেড। এতে বুঝা যায় তখন ধাতুবিদ্যা বেশ অগ্রসর হয়েছিল। দাউদ ও সুলায়মান
(আ.) সম্পর্কে কুরআন বলেছে ... এবং আমি উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়েছিলাম । সূরা
আম্বিয়া ৭৯)। আরো বলা হয়েছে, আমি তাঁকে তোমাদের জন্য বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম,
যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। অতএব, তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে? এবং সুলায়মানের
অধীন করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ুকে, তা তাঁর আদেশে প্রবাহিত হতো ঐ দেশের দিকে,
যেখানে আমি কল্যাণ দান করেছি। আমি সব বিষয়েই সম্যক অবগত আছি।’ (ঐ-৮০-৮১)
নবী সুলায়মান কিভাবে এসব ধাতুর জিনিস
তৈরি করতেন, তা নিয়ে পাশ্চাত্য পুরাতত্ত্ববিদরা উঠে পড়ে লেগেছেন। ১৯৪০ সালে একদল
আমেরিকান প্রতœতত্ত্ববিদ আকাবা উপমহাসাগরের কাছে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখতে পান যে,
এখানে Blast Fuenace এর মতো তামা লোহা গলানোর ফার্নেস ছিলো। আর এসব ফার্নেস
ব্যবহার করেই পিতাপুত্র নবীদ্বয় ধাতু গলানোর কাজ করতেন। ওয়াদী আর আরাবাতে প্রবাহিত
অবিরাম বায়ুপ্রবাহ তাতে হাপরের কাজ করতো।
বিজ্ঞান পরিকল্পনা মুসলিম প্রযুক্তির
বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি এমন দরদ
ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শিত হয়েছিল যে, সাম্রাজ্য যেনো বিজ্ঞান চর্চার আদর্শ ক্রোড়ে
পরিণত হয়েছিল। বহু মুসলিম খলিফার জ্ঞানস্পৃহা ছিল অসামান্য। আল মামুন, আল হাকাম,
উলুগবেগ প্রমুখ শাসকগণ নিজেরাই ছিলেন অসামান্য বিদ্বান-পণ্ডিত্যের অধিকারী
বিজ্ঞানী। শাসকরা ছিলেন বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তার ছায়ায়। রাজনীতির উত্থান-পতন যাই
হোক তাদের কখনো বিপদে পড়তে হতো না।
মুসলিম জাতির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
ক্ষেত্রে যে বিশাল অবদান ছিল তার আদ্যোপান্ত বর্ণনা এতো অল্প পরিসরে সম্ভব নয়।
মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের বহু আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ইউরোপীয়রা
সচেতনভাবে নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। মুসলিম দেশের মুসলিম ছাত্ররাও আজ
জানতে পারছে না বিজ্ঞান বিষয়ে তারা যে থিওরি পশ্চিমাদের আবিষ্কার বলে মুখস্থ করছে
তার কোনো কোনটি তাদের পূর্ব পুরুষ কোনো মুসলিম বিজ্ঞানীর আবিষ্কার। এমনভাবে বহু
কালজয়ী বিজ্ঞানীর নামও তারা বিকৃত করে ফেলেছ্ েযাতে তাঁর জাতি-পরিচয় চেনা না যায়।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, পাশ্চাত্যেরই
সত্য সন্ধানী অনেক ঐতিহাসিক, বিজ্ঞান বিষয়ক ইতিহাসের গবেষক প্রমাণ করেছেন যে,
আরবরাই পাশ্চাত্য সভ্যতার আসল জনক। এ রকম কয়েকজন লেখক হলেন G. Sarton, sir T.Amold. R. A. Nicholson, Hiti
Draper, Gibb, Goseph Hall প্রমুখ।
ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদান
ইসলামপূর্ব ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল
নির্বোধের আত্ম অহঙ্কারে পরিপূর্ণ। যদিও তখন তাদের ধুতি চাদর ছাড়া কোনো পোশাক ছিল
না, হালাল হারাম জ্ঞান ছিল না, শ্রেণিভেদের অন্ধকারে মানবতাবোধ ছিল না। প্রখ্যাত
ভারত তত্ত্ববিদ আল বিরুনী বলেন : ভারতীয়দের অবিচল বিশ্বাস যে, ভারতই শ্রেষ্ঠ।
ভারতীয়রাই শ্রেষ্ঠ জাতি, ভারতীয় রাজপুরুষরাই শ্রেষ্ঠ রাজন্যবর্গ, ভারতের ধর্মই
শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান, শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান। ভারতীয়
বিদ্বানমণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি আরো লিখেছেন : জ্ঞান কার্পণ্য তাদের
স্বভাব এমনকি স্বজাতির নিম্নবর্ণ থেকে এ শাস্ত্র জ্ঞান সযতেœ তারা লুকিয়ে রাখে
সুতরাং বিভিন্ন জাতির কথা বলাই বাহুল্য। পৃথিবীতে ভারত ছাড়া আরো দেশ আছে, আছে আরো
বহু জাতি এবং তাদের রয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্র ও শাস্ত্রজ্ঞানÑ এটা তাদের কল্পনার
বাইরে। এমনকি পারস্য ও খুরাশানের জ্ঞানীগুণীদের সম্পর্কেও তারা বিস্ময় জড়িত অজ্ঞতা
প্রকাশ করে’।
ভারতে মুসলমানদের আগমন তাদের হাজার বছরের
অজ্ঞতা টুটে যায়। নতুন সভ্যতা সংস্কৃতি নতুন চিন্তাধারা প্রবেশ করে ভারতে।
মুসলমানদের আগমনে ভারতীয় সংস্কৃতির দুর্বলতা ভারতবাসীর নিকট প্রকট হয়ে উঠে। মুসলিম
সংস্কৃতিকে সম্মুখে উপস্থিত দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।
৭১১ সালে আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতীয়দের
উপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে। ব্রাহ্মণ্যবাদের নিষ্পেষণ, বৌদ্ধধর্মের কণ্ঠরোধ এবং
নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দুরাবস্থা সিন্ধুতে মুসলিম আগমনকে উৎসাহিত করে। মুসলমানদের
রাজনৈতিক বিজয়ের পর পুরো ভারত মানস এক নতুন প্রেরণায় জেগে উঠে। মুসলিম বিজয় ভারতীয়
সংস্কৃতির বিবর্তনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে সবকিছু ওলট-পাট হয়ে যায়।
ইসলামের প্রাণশক্তিকে অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি আর তাদের থাকে না। ভারতীয় জীবনধারার
ও সংস্কৃতির পরাজয় ঘটিল। ইসলামের উদার অহিংসনীতি দেখে দলিত হিন্দুরা সহসা
ইসলামের ছায়াতলে স্থান নিলো। শত জাতপাতের দঙ্গল ডিঙ্গিয়ে একই কাতারে সবাই সামিল
হলো। এ যেনো এক অদ্ভূত জাগরণ। হিন্দু সমাজের নিম্নস্তরের চোখের সামনে এঁকেছে এক
প্রলুব্ধকর ভবিষ্যতের ছবি, শুদ্রকে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার আর ব্রাহ্মণদের
উপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। এম এন রায় লিখেন : ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা ভারতীয়
জনগণের সমর্থন লাভ করলো, তার কারণ তার পেছনে জীবনের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল,
হিন্দু দর্শনের চাইতে তা ছিল শ্রেয়। কেননা, হিন্দু দর্শনই সমাজ দেহে এনেছিল বিরাট
বিশৃঙ্খলা, আর ইসলামই তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণকে মুক্তির পথ দেখায়।
ভারতীয় সভ্যতায় মুসলিম সংশ্লিষ্টতার অনেক
বৈশিষ্ট্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। আগে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাষ্ট্রের
অস্তিত্ব ছিল না। হিন্দু শাসিত সাম্রাজ্যগুলো কয়েকটি স্বাধীন প্রদেশের সমষ্টি।
এদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক জাতীয়তা ছিল না। ভাষা ও শাসন পদ্ধতির ছিল না
কোনো ঐক্য। অথচ বাদশাহ আকবর হতে মুহাম্মদ শাহ পর্যন্ত (১৫৫৬-১৭৪৯) শাসনামলে উত্তর
ভারত ও দক্ষিণাত্যের অধিকাংশ স্থানে এক সরকারি ভাষা, একই শাসন পদ্ধতি ও একই মুদ্রা
প্রবর্তিত হয়। সকল শ্রেণির লোকের মধ্যে একই জনপ্রিয় মিশ্রভাষার সৃষ্টি হয়। শাহী
সাম্রাজ্যের বিশটি সুবা একই শাসনযন্ত্রের সাহায্যে একই রীতিতে শাসিত হতো। সমস্ত
সরকারি দলিল দস্তাবেজ, পাট্টা, সনদ ফরমান, চিঠিপত্র রশিদ ফারসীতে লিখিত হতো।
সাম্রাজ্যে একই মুদ্রানীতি, মুদ্রার একই নাম ও আকার ছিল। সুতরাং এই বিরাট
রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে গেলে বুঝা যেতো এটা একটি কেন্দ্রীয় শাসনাধীন রাষ্ট্র।
সর্বভারতীয় শাসন কাঠামো এই প্রথম একটি শক্তিশালী আধুনিক ভিত্তি লাভ করে। মুসলিম
রাজ্যের উজীর, কাজী, মুন্সী প্রভৃতি আমলাদের নম ও পদবী এবং রাজপথে ব্যবহৃত ফারসী
ভাষাই ক্রমে দেশীয় শাসনের ধারা হয়ে ওঠে, হিন্দু রাজ্যেও তা গৃহীত হয়। ঠিক ঐরূপ
রাজপুরুষদের ও অভিজাতদের আদব কায়দা, খেতাব খেলাত উর্দি কুর্তা প্রভৃতি ও
মুসলমানদের নিকট থেকে ভারতবাসী সকলেই লাভ করলো। এসব আজো ভারতে হিন্দু মুসলমান
সকলের দরবারী পোশাক ও কায়দা কানুন।
ভারতীয় সাহিত্য মুসলমানদের কাছে চির ঋণী।
বিজেতারা অন্য ভাষী হলেও স্থানীয় ভাষাকে প্রথম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।
বাংলা, হিন্দি প্রভৃতি ভাষাকে শক্ত ভিত্তি ও সাহিত্যিক রূপ প্রদানে তাদের অবদান
নিয়ে অনেক গ্রন্থও রচিত হয়েছে। গোপাল হালদার লিখেছেন : ইহাদের আসরে দেশীয়
ভাষাগুলোর আদর বাড়িল। তাই সাধারণ লোকের এই বার রূপ গ্রহণ করিতে লাগিল। ভারতবাসীর
সাহিত্য আর প্রধানত দোভাষায় আবদ্ধ রহিল না। এইভাবে বাংলা হিন্দি প্রভৃতি বর্তমান
ভারতীয় ভাষাগুলো এই সময়ই প্রথম সৃষ্টি লাভ করিল। বাংলায় ইহার প্রমাণ পরাগল খাঁ ও
ছুটি খাঁর মহাভারত লেখানো। হোসেন শাহের সভাতে বাংলা কাব্যের পুষ্টি, বাংলার আমলা
মুনসি প্রভৃতি ফারসী জানা কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ভদ্রলোক মধ্যবিত্তদের তাহা
জন্মধাম। এদিকে পাঠান যুগেই হিন্দি আমরা পাই মালিম মুহাম্মদ জৈসীর ‘পদ্মাবৎ’ কবীরের দোহাবলী আর তুলসী দাসের
রামচরিত মানস মুঘল যুগের প্রশস্থ অবকাশে এই সকল ভাষা ক্রমে ক্রমে প্রকৃত সাহিত্যিক
রূপ লাভ করেছে। বাংলাভাষা বিকাশে মুসলমানদের যে অবদান তা অবিস্মরণীয়। হিন্দু
শাস্ত্রকাররা যেখানে এই ভাষা চর্চাকারীকে নরকবাসী হওয়ার কারণ মনে করতেন সেখানে মুসলমানদের
পরিপোষকতায় এ ভাষা নতুন প্রাণ ফিরে পায়। হিন্দু সমাজে অসংখ্য কুসংস্কার ও অন্ধ
বিশ্বাস ছিল। স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে জীবন্ত স্ত্রীকে পুড়ে মারা ছিল তাদের
ধর্ম। নারীদের কোনো অধিকার ছিল না, বিধবাদেরকে পরিবারে দাসীদের চেয়ে তুচ্ছ
মনে করা হতো। শ্রেণিভেদ ছিল ভয়াবহ। সমাজের উপর তলার মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া আর
সবাই ছিল তাদের সেবা দাসদাসী। মাকরসার মতো মূল্যহীন ছিল তাদের জীবন। গোড়া হিন্দু
সম্প্রদায় কোনো জাতির কাছ থেকেই ভালো কিছু গ্রহণ করতে চায় না, মুসলমানদের কাছ থেকে
আরো বেশি দূরে সরে থাকতে চায়, তারপরও দীর্ঘকাল পাশাপাশি বসবাস করার ফলে তাদের
কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস অনেক দূর হয়েছে, কিছু সংখ্যক সত্য সন্ধানী লেখকও তাদের
মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক খুশবন্ত সিং লিখেছেন :
আমাদের মুসলিম শাসকবর্গের প্রতি আমাদের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকগুলো যে, কত দূর অসাধু
হয়েছে,বর্তমান প্রজন্ম তা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। তারা অধিকাংশ হিন্দু
খাদক, বিগ্রহ সংহারক ও তরবারির সাহায্যে ধর্মান্তকারীরূপে চিত্রিত। আমি যদি
আপনাদের বলি যে, এই কালো চিত্রগুলো সত্যের বিকৃতি, মুসলিম অবিশ্বাসকে চিরস্থায়ী
করার জন্য ভেবেচিন্তে মিথ্যা উদ্ভাবক করা হয়েছেÑ তাহলে আপনাদের অধিকাংশই আমাকে
বিশ্বাস করবেন না। পৃথিবীর কোনো সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মতো ইসলামের ইতিহাস
সম্পর্কে এমন অজ্ঞ নয় এবং ইসলাম সম্বন্ধে এমন ঘৃণাও পোষণ করে না। ভারতীয়
অধিবাসীদের কল্যাণে এবং বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক সততার স্বার্থে, তাদের এ বিরূপ
মনোভাবের নিরসন অপরিহার্য কর্তব্য। ভারতের ইতিহাস যে চরম পর্যায়ের ভেতর দিয়ে
অগ্রসর হচ্ছে, তাতে ইসলামের সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সম্যক উপলব্ধির গুরুত্ব আজ
অপরিসীম হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক
সভ্যতার অধিনায়ক হয়ে রইলো। এমন কি আজো তার শ্রেষ্ঠ মনীষীরা অতীত ঋণের বোঝা স্বীকার
করতে দ্বিধাবোধ করেন না।
আধুনিক বিশ্ব সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের
শুধু দু’চারটি শাখায় নয়, বরং সকল শাখায়ই
মুসলমানদের প্রচুর অবদান রয়েছে। অর্থাৎ মুসলমানরাই প্রথম জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও সভ্যতার
আলো জ্বেলে সারা বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।