১৭ রমজানঃ ঐতিহাসিক বদর দিবস, মানবতার প্রথম বিজয় :
১৭ রমজান
ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরি দ্বিতীয়
বর্ষের রমজান মাসের
এই দিনে বদর
প্রান্তরে ইসলামের প্রথম সম্মুখযুদ্ধে মহান রাব্বুল আলামিন মুসলমানের বিজয় দান করেন। তাই এ
দিবসকে ইয়াওমুল ফুরকান বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের দিন বলা হয়। সত্যপথের অনুসারী অল্পসংখ্যক রোজাদার মুসলমান বিশাল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিথ্যার অনুসারী কাফের মুশরিক
বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে
সত্য-মিথ্যার চিরপার্থক্য সূচিত হয়।
হজরত মুহাম্মদ
সা. ও তার
অনুসারীরা মক্কা থেকে
মদিনায় হিজরত করে
শান্তিতে অবস্থান করবেন, চতুর্দিকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবেন, হজরত মুহাম্মদের
সা. নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে এটা
কাফের কুরাইশ বাহিনী কখনোই চায়
নি। কোনো মুসলমান
পেলেই কোনো কারণ
ছাড়াই শুধু ঈমান
আনার অপরাধে তার ওপর অত্যাচারের
খড়গ চালাতো। নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে হত্যা করতে
বিবেকে বিন্দুমাত্র নাড়া দিতো না।
এদিকে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান
ও তার বাহিনী
সিরিয়া থেকে বিভিন্ন
রসদ সামগ্রী নিয়ে মক্কায় ফিরছিলো। মহানবী সা. তার সাহাবাদেরকে
কুরাইশদের গতিরোধ করার জন্য নির্দেশ
দেন। মুসলমান বের হয়েছে এ
সংবাদ মক্কায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে
তারা রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মদিনায়
আক্রমণ ও মুসলমানের
নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে
বদর প্রান্তরে এসে জড়ো হয়।
এদিকে আবু
সুফিয়ান ও তার
দল রাস্তা পরিবর্তন করে নিরাপদে
পৌঁছে যায়। মহানবী
সা. এর সঙ্গে
জনবল ছিলো মাত্র
৩১৩ জন। এদের
৭০ জন মুহাজির
ও বাকিরা আনসার। অপরদিকে কাফের, কুরাইশ বাহিনীর সংখ্যা ছিলো ১ হাজার।
তন্মধ্যে ১০০ জন
অশ্বারোহী, ৭০০ জন
উষ্ট্রারোহী ও বাকিরা
পদব্রজী ছিলো। মূলত
মুসলমানদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিলো না
বরং কাফেরদের ব্যবসায়ী কাফেলাকে ধরা উদ্দেশ্য ছিলো। রাসুল সা.
যখন কাফেরদের বের হওয়ার কথা
জানতে পারলেন তখন সাহাবাদের সংঘবদ্ধ করে বললেন,
নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার সঙ্গে ওয়াদা
করেছেন দুটি দলের
একটি হয়তো ব্যবসায়ী
কাফেলা অথবা অন্যটি
সৈন্যবাহিনী। সাহাবাগণ রাসুলুল্লাহ সা. এর
বিচলিত অবস্থা দেখে বললেন যে,
হে রাসুল সা.
আপনি আমাদেরকে ধৈর্যশীল, যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ় অবস্থানকারী,
আনুগত্যশীল, সাহসী, অকুতোভয় ও নির্দেশ
বাস্তবায়নে আপোসহীন ও দ্রুতগামী পাবেন। নবী করিম
সা. মুহাজির ও আনসারদের কথা শুনে খুশি
হয়ে বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি
আল্লাহ তায়ালার শপথ করে বলছি
আমার এমন মনে
হচ্ছে যে, আমি
যেনো মুশরিক জাতির হত্যাযজ্ঞ লক্ষ্য করছি। অতপর
নবী করিম সা.
সাহাবিদের নিয়ে বদর
কূপের কাছে পৌঁছান।
কুরাইশরা অপর প্রান্তে অবস্থান করলো। রাতে
আল্লাহ তায়ালা এমন বৃষ্টিবর্ষণ করেন যা কাফিরদের
জন্য বিরাট বিপদ
হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা সম্মুখে
অগ্রসর হতে পারে
নি। অপরদিকে মুসলমানের জন্য সুবিধা
হয়। সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলে রাসুলুল্লাহ
সা. আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে
ফরিয়াদ করতে থাকেন।
রাসুলুল্লাহ সা. দোয়ায়
বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! এ কঠিন মুহূর্তে
আপনি আমাকে সাহায্য
করুন, যার প্রতিশ্রুতি
আপনি আমাকে দিয়েছেন,
হে আল্লাহ! আমি আপনার প্রদত্ত
ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির
শপথ করে বলছি,
যদি আপনি বিজয়ী
না করেন, তাহলে
এ পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার
কেউ থাকবে না।
মহান রাব্বুল আলামিন রাসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবাদের
ডাকে সাড়া দিলেন।
যা আল কুরআনের
সুরা আল আনফালের
১২-১৪ আয়াতে
আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন, ‘আর স্মরণ করুন
সেই সময়ের কথা,
যখন আপনার রব
ফেরেশতাদের কাছে এ
মর্মে প্রত্যাদেশ পাঠালেন যে, নিশ্চয়ই
আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমরা
পরস্পর ঈমানদারদের মনোবল ও সাহস
বৃদ্ধি কর।
আর আমি
অচিরেই কাফেরদের অন্তকরণে ভয়-ভীতি
সৃষ্টি করবো। তোমরা
কাফিরদের ঘাড়ে আঘাত
কর এবং জোড়ায়
জোড়ায় আঘাত কর।’
অন্যত্র বলা হয়েছে,
‘আর আল্লাহ এমন সৈন্যবাহিনী দিয়ে তোমাদের সাহায্য করেছেন যা তোমরা দেখো
নাই।’ রাসুল সা.
এর উৎসাহব্যঞ্জক
কথা শুনে উমাইর
ইবনে হুমাম রা.
হাতের খেজুর ফেলে
দিয়ে বলতে লাগলেন,
আমি কি শহিদ
হলে জান্নাতে যাবো? রাসুল সা.
উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। এ কথা
শুনে উমাইর রা.
খেজুর রেখে দিয়ে
বললেন, আমি যদি
জীবিত থাকি এবং
খেজুরগুলো খেতে থাকি,
তাহলে আমার জীবন
দীর্ঘ হয়ে যাবে।
এ বলেই তিনি
খেজুর নিক্ষেপ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শাহাদাতবরণ
করলেন। যুদ্ধে কাফের কুরাইশ বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে
এবং তারা যুদ্ধের
ময়দান ছেড়ে পলায়ন
করে। ৭০ জন
কাফের নিহত ও
৭০ জন বন্দি
হয়। অপরদিকে মুসলমানের মধ্য হতে
১৪ জন শহীদ
হন।
এ বিজয়ের
মাধ্যমেই মূলত পৃথিবীতে
সত্য ও মানবতার
জয়যাত্রা শুরু হয়।
যা আজও পৃথিবীতে
অব্যাহত আছে। ইসলামের
ইতিহাসে দিগি¦জয়ের
যতো গৌরব আছে,
সব এই গৌরবের
কাছে বিনীতভাবে ঋণী। শুধু তাই
নয়; এ বিজয়
সত্যের পথে সংগ্রামের
অন্তহীন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
বদরের যুদ্ধ
ও আল্লাহর সাহায্য:
ইতিহাসে যতগুলো যুদ্ধ মুসলমানদের
সাথে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর
মধ্যে কিংবা বিধর্মীদের
সাথে সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে
বদরের যুদ্ধ ছিল
মুসলমানদের জন্য অত্যধিক
গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ বদরের যুদ্ধের
তাৎপর্য ছিল
ঐতিহাসিক। বদরের যুদ্ধ ছিল
ইতিহাস নির্ধারণকারী একটি যুদ্ধ। যদি বদরের
যুদ্ধে মুসলমানগণ পরাজিত হতেন তাহলে
দ্বীন ইসলামের ভাগ্যে কী ছিল
কিংবা মহান আল্লাহ্
তা’য়ালার নাম ডাকার মতো
কোনো লোক এই
পৃথিবীতে থাকত কি
না তা কেবল
সেই মহান সৃষ্টিকর্তা
ছাড়া আর কারো
জানা ছিল না। শত্রুগণের দৃষ্টিতে বদরের যুদ্ধ
ছিল উদীয়মান বা নব অঙ্কুর,
সবেমাত্র চারা গজাচ্ছে
এই ইসলাম নামক
ধর্মটিকে আল্লাহ্র জমিন থেকে নিশ্চিহ্ন
করে দেয়ার যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের অপর একটি তাৎপর্য হলো দ্বীন
ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আমাদের
প্রিয় নবী হযরত
মুহাম্মদ (সা.)-কে
একজন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে
হয়েছে। বদরের যুদ্ধের তৃতীয় তাৎপর্য হলো যে
মহান আল্লাহ্ তায়ালা অনেকটাই অদৃশ্যমানভাবে তার প্রিয়
বান্দাদের বিপদে কীভাবে
সাহায্য করেন তার
জ্বলন্ত প্রমাণ এই যুদ্ধে বিদ্যমান। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত
হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয়
সালে রমজান মাসের
১৭ তারিখে বদরের কথা বলতে
গিয়ে বলতে হয়,
মূলত বদর একটি
জায়গার নাম। মক্কা শরীফ
থেকে কিছুটা উত্তরে, মদিনা শরীফ
থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে। প্রায় চৌদ্দশ’ ত্রিশ কিংবা
একত্রিশ বছর আগে
ওই আমলের আরব
দেশে মক্কা নগরীর
কুরাইশদের সাথে যে
বাণিজ্য হতো সেই
বাণিজ্যের কাফেলাগুলো চলাচল করার যে
পথ ছিল সেটি
‘বদর’ নামক জায়গার
পাশ দিয়েই যেত।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে
মদীনায় হিজরত করে
চলে এলেন। তারপর
মদীনায় নতুন একটি
নগররাষ্ট্র, নতুন সভ্যতা,
সংস্কৃতি, স্বকীয়তা ও দ্বীন ইসলামের
মূল কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলার জন্য
নিরলস কাজ করে
যাচ্ছিলেন। এটা দেখে
মক্কার কুরাইশগণ ঈর্ষান্বিত হলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত
হয়ে তারা নানা
ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে
লাগল। মক্কার কুরাইশগণ চিন্তা করল যে, আমরা
তো সবাই মিলে
মক্কায় তাকে (মুহাম্মদ
সা.) দমন করে
রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন মদীনায়
গিয়ে তিনি নতুন
রূপে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন। যদি এরূপ প্রচার
অব্যাহতভাবে চলতে থাকে
আর তার এই
সংগ্রাম সামনে অগ্রসর
হতে থাকে তাহলে
অচিরেই মদীনার মুসলিমগণ মক্কার লোকজনের প্রতি হুমকি
হয়ে দাঁড়াবে। অতএব তাদের অঙ্কুরেই
বিনাশ করা প্রয়োজন।
অপর দিকে,
মাত্র জন্ম নেয়া
মদীনা নামক নগররাষ্ট্র
তথা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ক্রমবর্ধমান হচ্ছিল, যেটি সেখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ
(সা.) এবং তার
সাথীরা চিন্তা করলেন যে, আমরা
মক্কা থেকে বের
হয়ে এসেছি সত্য,
কিন্তু মক্কার হুমকি থেকে আমরা
এখনো মুক্ত হতে
পারিনি। আমরা এখনো
তেমন শক্তি অর্জন
করতে পারিনি। তাই আগে আমাদের
শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন এবং আল্লাহ্র দ্বীনকে তার জমিনে
প্রতিষ্ঠা করতে হলে
যুদ্ধের কোনো বিকল্প
নেই। মোটামুটি এ ধরনের চিন্তাভাবনার
প্রেক্ষাপটের পরেই মক্কা
ও মদিনা এই
দুই শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠির মধ্যে একটি
যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া পরোক্ষভাবে
আল্লাহ্ তা’আলার
পক্ষ থেকে নির্দেশ
এলো যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করার।
অবশেষে রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে
মদীনা থেকে মুসলমানদের
একটি দল বের
হলো। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়াগামী
মক্কা নগরীর আরবদের
বাণিজ্য কাফেলা, যেটা সিরিয়া থেকে ধনসম্পদ নিয়ে মক্কায় ফেরত যাবে তাদের
মোকাবেলা করা। সে
জন্য তারা চলাচলের
রাস্তার পাশে ওঁৎ
পেতে ছিল। অপর
দিকে ধনসম্পদ নিয়ে মক্কা নগরীর
ব্যবসায়ীদের কাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরত
যাওয়ার সময় সংবাদ
পেল, এই পথ
ধরে গেলে পথিমধ্যে
তাদের বিপদে পড়ার
সম্ভাবনা আছে। তাই
তারা সবার সিদ্ধান্তক্রমে
তাদের গতিপথ একটু
পরিবর্তন করে মক্কায়
যাওয়ার জন্য নতুন
পথ আবিষ্কার করল এবং সেই
পথ ব্যবহার করে তারা মক্কার
কাছাকাছি চলে গেল।
কিন্তু ইতোমধ্যে অন্য একটি ঘটনার
উদ্ভব হলো। বাণিজ্য
কাফেলার অনুরোধে মক্কা থেকে একদল
সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রওনা
দিয়েছিল বাণিজ্য কাফেলাকে এগিয়ে আনার জন্য। মক্কা
থেকে উত্তর দিকে
যে পথ ধরে
বাণিজ্য কাফেলা আসছে, সেই পথ
ধরে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বাণিজ্য কাফেলার ওপর কোনো বিপদ-আপদ হলে যেন
তারা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে।
কিন্তু বাণিজ্য কাফেলা মদিনার মুসলমানদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেল,
এমনকি মক্কা থেকে
আসা সাহায্যকারী লোকদেরও দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল।
মক্কা থেকে আগত
সাহায্যকারী দল যখন
বদর নামক স্থানে
এসে অবস্থান করছিল তখন তারা
সংবাদ পেল মুসলমানগণ
তাদের আশপাশে আছে। আবার মুসলমানগণ
বদর নামক স্থানটির
কাছেই অবস্থান করেছিল; ফলে তারাও
জানতে পারল মক্কা
থেকে আগত অস্ত্রশস্ত্রে
সজ্জিত একদল সৈন্যবাহিনী
তাদের পাশে অবস্থান
করছে। যুদ্ধটি চূড়ান্ত রূপে দেখা
দিলো। বদর নামক
স্থানে কাফেরেরা এক দিকে অবস্থান
নিল, অন্য দিকে
মুসলমানগণ অবস্থান নিলেন। মুসলমান বাহিনী যে স্থানটিতে
অবস্থান নিল সেখানে
একটি পানির কূপ
ছিল। যেহেতু পানির কূপটি মুসলমানদের
দখলে সেহেতু কাফেররা পানির সঙ্কট
অনুভব করল। কূপের
পাশেই একটি পাহাড়,
সেখানে মুসলমানদের সদর দফতর স্থাপন
করা হলো। একটি
তাঁবুর বন্দোবস্ত করা হলো, সেখানে
রাসূলে পাক (সা.)
অবস্থান নিলেন। এলাকাটি ছিল সমতল,
কিন্তু তিন দিকে
ছিল পাহাড়-বেষ্টিত।
বদরের যুদ্ধে
মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা আর কাফেরদের সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে ছোটখাটো মতপার্থক্য আছে। তবে যে
মতামতটি জোরালোভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা এ
রকম : মুসলমানগণ ছিলেন ৩১৩ জন,
অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক
হাজার। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির
মধ্যে ৮৫জন ছিলেন
মুহাজির সাহাবি; বাকি সবাই ছিলেন
মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১
জন আউস গোত্রের
আর বাকি ৬৯
জন ছিলেন খাজরাজ
গোত্রের। পুরো ৩১৩
জনের দলে উট
ছিল ৭০টি আর
ঘোড়া ছিল মাত্র
দু’টি। অপরপক্ষে
কাফেরদের এক হাজারের
দলের ৬০০ জনের
কাছে ছিল দেহ
রক্ষাকারী বর্ম এবং
তাদের কাছে ঘোড়া
ছিল ২০০টি।
যুদ্ধের ক্ষেত্রটির অবস্থান এবং পরিবেশের বর্ণনা দেয়া অবশ্যই
প্রয়োজন। মুসলমানেরা যে স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপরে
পতিত হয়। কিন্তু
কাফেরদের মুখে দিনের
বেলায় সূর্যের আলো পড়ে না।
মুসলমানেরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন
সেখানের মাটি একটু
নরম, যা যুদ্ধক্ষেত্রের
জন্য উপযুক্ত নয়। অপর দিকে
কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানের মাটি শক্ত
এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি উপযুক্ত। কিন্তু অবস্থান নেয়ার ফলে অবশেষে কী হলো? পাঠক
মনে করুন আমরা
সবাই সেই রাত্রিতে
অবস্থান করছি! রমজান
মাসের ১৬ তারিখ
দিনটি শেষ মাগরিবের
পর তারিখ বদলে
গেল, অতঃপর ১৭
রমজান শুরু হলো।
সেই রাতে উৎকণ্ঠিত মুসলমানগণ এবং কাফেররা নিজ নিজ ক্যাম্পে
অবস্থান করছে। সেই
রাতে মহান আল্লাহ্
তা’য়ালার নিকট সেজদায় পড়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন মানবতার
মুক্তির দূত হযরত
মুহাম্মদ (সা.). কেঁদে
কেঁদে বলেছিলেন অনেকটা এ রকম
: ‘হে দয়াময় আল্লাহ্, আগামীকালের নীতিনির্ধারণী যুদ্ধে তোমার সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন।
এই যুদ্ধে আমরা তোমার সাহায্য
ছাড়া বিজয় লাভ
করতে পারব না।
আর আমরা যদি
পরাজিত হই হয়তো
তোমাকে সেজদা করার
কিংবা তোমার নাম
ধরে ডাকার লোক
এই পৃথিবীতে আর নাও থাকতে
পারে। অতঃপর তুমি
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো
কী করবে; কারণ
তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মালিক।
আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রাণপণ
যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। আমরা আমাদের
জীবন তোমার পথে
উৎসর্গ করলাম।
বিনিময়ে তোমার দ্বীনকে
আমরা তোমার জামিনে
প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
তুমি আমাদেরকে বিজয় দান করো।
আমরা তোমার কাছে
সাহায্য চাই।’ রাসূল
(সা.)-এর আন্তরিক
আকুতি-মিনতি মহান
আল্লাহ্র নিকট কবুল
হয়ে গেল। হযরত
জিব্রাঈল (আ.)-এর
মাধ্যমে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে জবাব
এলো- সাহায্য আসবে, তোমার যুদ্ধের
জন্য প্রস্ত্তত হও, তোমাদের শিরকে উঁচু করো
এবং দৃঢ় পদক্ষেপে
দাঁড়াও।
পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালের
৯ নম্বর আয়াতে
মহান আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণাটি দিয়েছেন।
ওই রাতে
মরুভূমিতে প্রবল বৃষ্টি
হলো। যেটি একটি
ব্যতিক্রমী ঘটনা। বৃষ্টি
মুসলমানদের উপকারে লাগল। কারণ বৃষ্টির
কারণে কাফেরদের যুদ্ধের মাঠের শক্ত
মাটি কাদায় ভরে পিচ্ছিল হয়ে গেল। অপর
দিকে মুসলমানদের যুদ্ধের মাঠ শক্ত
হয়ে গেল। বৃষ্টির
কারণে আবহাওয়া শীতল হলো, উৎকণ্ঠিত উদ্বিগ্ন মুসলমানগণের চোখে তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে
প্রশান্তি এসে গেল।
অপর একটি ঘটনা,
যেটি মহান আল্লাহ
তায়ালা ঘটিয়েছেন কাফেরেরা যখন মুসলমানদের
ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল
ঠিক তখন কাফেরদের
চোখে মুসলমানদের ক্যাম্প অনেক বড়
মনে হচ্ছিল। তারা চিন্তায় পড়ে গেল এত
মুসলমান কোত্থেকে এলো! অপরপক্ষে মুসলমানগণ যখন কাফেরদের
ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল
তখন কাফেরদের ক্যাম্প মুসলমানদের চোখে অনেক ছোট
মনে হচ্ছিল এবং তারা ভাবতে
লাগল কাফেররা তো তেমন বেশি
না; আগামীকালের যুদ্ধে এদেরকে আমরা পরাজিত করতে পারব। অতঃপর
এমন মনে হচ্ছিল
যে মুসলমানগণের চোখে দেখা দিয়েছিল
অন্য এক স্বপ্ন
যে, আমরা তাদের
সমান সমান। আর
এ ধরনের চিন্তা-চেতনা মহান আল্লাহ্
তায়ালার পক্ষ থেকে
মুসলমানদের মনে ঢুকিয়ে
দেয়া হয়েছিল, যাতে করে মুসলমানেরা
তাদের মনোবল হারিয়ে
না ফেলেন। অতঃপর দিনের বেলায়
যুদ্ধ শুরু হলো।
প্রথমে তিনজন করে
উভয় পক্ষ থেকে
এলো এবং কাফেরদের
তিনজনই মৃত্যুবরণ করল। অতঃপর কথা
মোতাবেক উন্মুক্ত প্রান্তরে উন্মুক্তভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে
গেল। সেই আমলের
যুদ্ধের অস্ত্র হতো তরবারি, তীর, ধনুক, বর্ম,
বল্লম ইত্যাদি। মুসলমানগণ প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মহান আল্লাহ্
তা’য়ালা তার
প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মুসলমানদের সাহায্যের জন্য ফেরেশতা পাঠিয়ে দিলেন। সাধারণত ফেরেশতারা মানুষের চোখের অদৃশ্য
থাকে। কিন্তু যুদ্ধের পর সাহাবিগণ
সাক্ষী দিলেন যে,
আমরা মানুষ দেখিনি
তথা পরিচালনাকারী দেখিনি; কিন্তু আমরা দেখেছি দীর্ঘ আকৃতির তরবারি; যেগুলো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল।
আবার আরেকটি
পর্যায়ে যুদ্ধ চলাকালে
জিব্রাঈল (আ.) এসে
মহানবী (সা.)-কে
এসে জানালেন, হে আল্লাহ্র রাসূল, আপনি আপনার
হাতে এক মুষ্টি
ধুলো নিন আর
শাহাদাত আঙুল ইশারা
করে কাফেরদের দিকে ছুড়ে দিন।
রাসূল (সা.) এক
মুষ্টি ধুলো তার
হাতে নিলেন এবং
শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ
করলেন।
সম্মানিত পাঠককুল বিষয়টি আসলেই আশ্চর্যের। আমরা চাইলেই এক মুষ্টি ধুলো কিংবা বালু
হাতে নিয়ে এ
কাজটি করতে পারি।
শিশুরা খেলার মাঠে
দুষ্টুমিবশত এ কাজটি
করে থাকে। কিন্তু
চিন্তা করার বিষয়টি
হলো এক মুঠ
ধুলো যদি কেউ
কারো দিকে ছুড়ে
দেয় তাহলে তা
কত দূর উড়ে
যাবে? কিন্তু অসংখ্য প্রমাণ এসেছে সেই বদরের
মাঠে রাসূলের ছুড়ে দেয়া ধুলো
সেদিন অনেক দূর
পর্যন্ত গেছে এবং
সব কাফেরের চোখে-মুখে নাকে
গিয়ে লেগেছে। এ ছাড়া পবিত্র
কুরআনের সূরার মাধ্যমে
মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা সাক্ষ্য
দিয়ে বলেছেন, ‘হে রাসূল, সেদিন সেই ধুলো
আমি সবার চোখে
পৌঁছে দিয়েছি। আপনি কেবল নিক্ষেপ
করেছেন। এর কারণ
ছিল কাফেররা যেন ভালোভাবে তাদের যুদ্ধের অবস্থান না দেখতে
পারে এবং অতি
দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়; এমনকি
বলা হয়েছে তারা তাদের হাতের
অস্ত্র ছেড়ে চোখ
কচলাতে শুরু করেছিল।
একটু চিন্তা করলে দেখা যায়
যদিও আমরা জাগতিক
দৃষ্টিতে দেখলাম ধুলোগুলো রাসূল (সা.) তার হাত
দিয়ে ছুড়েছেন, কিন্তু এই এক
মুষ্টি ধুলো কিভাবে
শত্রু বাহিনীর চোখে গেল? তাই
বলতে হচ্ছে এটা
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সম্ভব নয়, এটা
হয়েছে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে; যা স্বয়ং
আল্লাহ্ ঘটিয়েছেন। আর এটাই হলো
ঐশী বা গায়েবি
সাহায্য।
বোখারি শরীফের হাদিস মোতাবেক
যুদ্ধের শেষে সাহাবিগণ
সাক্ষী দিয়েছেন কেউ কেউ যে,
আমরা সাদা পোশাক
পরিহিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি।
তাদেরকে আমরা যুদ্ধের
আগে কখনো দেখিনি
এমনকি যুদ্ধের পরেও দেখিনি। আবার কিছুসংখ্যক সাহাবি বলেছেন, আমরা তরবারি ব্যবহারকারীকে দেখছি না,
কিন্তু তরবারিটি দেখছি। তাদের তরবারিগুলো
আমাদের তরবারিগুলোর চেয়ে দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা এবং
সেগুলো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল। সেদিন সাদা পোশাক
পরিহিত ফেরেশতাদের আকৃতি কারো চোখে
দেখা গিয়েছিল আবার কারো চোখে
দেখা যায়নি। মূলত তারা ছিল
আল্লাহ্র প্রেরিত ফেরেশতা। মুসলমানদের হয়ে বদরের প্রান্তরে
তারা যুদ্ধ করেছিলেন।
যুদ্ধ শেষে দেখা
গেল যে কাফেরদের
মধ্য থেকে ৭০জন
নিহত হয়েছে এবং ৭০ জন
বন্দী হয়েছে। অপরপক্ষে মুসলমানদের মধ্য থেকে শহীদ
হয়েছিলেন ১৪ জন;
তার মধ্যে ছয়জন
ছিলেন মোহাজের সাহাবা, অপর আটজন
ছিলেন আনসার। এই যুদ্ধের আরেকটি ঘটনা হলো,
আল্লাহ্ তা’য়ালা
মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন ফেরেশতা দিয়ে। অপরপক্ষে মক্কাবাসী কাফেরদের পক্ষে যুদ্ধ করার
জন্য অভিশপ্ত ইবলিসও এসেছিল সেদিন। আর ইবলিস
এসেছিল সোরাকা নামক একজন ব্যক্তির
আকৃতি ধরে। কিন্তু
মক্কাবাসী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঠে নেমে যখন
সেই ইবলিস দেখল
আল্লাহ্র ফেরেশতাগণ মুসলমানদের পক্ষ হয়ে
যুদ্ধরত মাঠে বিদ্যমান,
ঠিক তখন ইবলিস
পালিয়ে যেতে লাগল।
কাফেরদের মধ্য থেকে
কেউ একজন বলে
উঠল, সোরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছো? সোরাকা তুমি কি বলোনি
যে, তুমি আমাদের
সাহায্য করবে? আমাদের
কাছ থেকে দূরে
সরে যাবে না?
সে সময় ইবলিস
(ছদ্মবেশে সোরাকা) বলল, আমি এখানে
এমন কিছু দেখতে
পাচ্ছি যা তোমরা
দেখতে পাও না।
আল্লাহ্কে আমার ভয়
হচ্ছে, তিনি কঠোর
শাস্তিদাতা। এরপর ইবলিস
আত্মগোপন করেছিল।
বদরের যুদ্ধ
ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম সমন্বিত
এবং যতটুকু সম্ভব পরিকল্পিত যুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানে সুবিধাজনক অবস্থান নেয়া, পানির উৎস
নিয়ন্ত্রণে রাখা, সূর্যের
আলোর গতিবেগ লক্ষ্য করে সৈন্যদের
দাঁড় করানো এবং
যুদ্ধের আগে শত্রুদলের
চার পাশ পর্যবেক্ষণে
রাখা ইত্যাদি বিষয় শিক্ষণীয়।
সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় ছিল অজাগতিক
তথা সব কিছুর
জন্য আল্লাহ্র ওপর ভরসা বা
তাওয়াক্কুল করা। তাওয়াক্কুলের
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় আমরা বলতে পারি
যে, নিজের দ্বারা
সম্ভব সর্বপ্রকার প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা
হবে, কিন্তু সাফল্যের জন্য সে
প্রস্ত্ততির ওপর নির্ভর
করা যাবে না,
সাফল্যের জন্য নির্ভর
করতে হবে একমাত্র
আল্লাহ্ তা’য়ালার
ওপর। বদরের যুদ্ধে
মুসলমানেরা জয়ী না
হলে কী হতে
পারত, সেটা কল্পনা
করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ্ তায়ালার অসংখ্য দয়া আর মেহেরবানির
বদৌলতে মুসলমানদের অগ্রযাত্রার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল এবং বদরের যুদ্ধের
মাধ্যমে তিনি নতুন
ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। আজ চৌদ্দ
শ’ চৌত্রিশ বছর পর বিশ্বের
সর্বস্তরের মুসলমানগণ সেই অকুতোভয় সৈনিকদের স্মরণ করবেন
এবং নিজেরাও প্রয়োজনে বদরের মতো
যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে পারেন
সেই মানসিকতায় বলীয়ান রূপে নিজেদেরও
সজ্জিত করবেন বলে
আশা করি। তবে
বদরের যুদ্ধ যেমন
ছিল আত্মরক্ষার্থে, তেমনি মুসলমানগণের সব যুদ্ধ হবে
আত্মরক্ষার্থে, সত্যের অনুকূলে, নির্যাতিত-নিপীড়িতদের অনুকূলে এবং কল্যাণ কামনায়।