23 June 2016

পলাশী যুদ্ধের পটভূমি : যুদ্ধোত্তর কোম্পানি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রতিক্রিয়া


ভূমিকা :

তখনো কেউ ভাবতে পারে নি যে লন্ডন শহরের আশিজন ফটকাবাজ সওদাগর মসলা ব্যবসা করার জন্য এসে গঠিত কোম্পানিই দক্ষিণ এশিয়ার এমন একটি বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করবেযা হবে সূর্যাস্তহীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটমণি। তাই কোন কর্ম যে কি ইতিহাস সৃষ্টি করে তা কেউ বলতে পারে না। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এসে একটি বাণিজ্যিক সংস্থা কর্তৃক ভারতবর্ষে স্বর্গরাজ্যের পতন ঘটিয়ে ঔপনিবেশিক রাজত্ব কায়েমের ঘটনাটিই বিশ্লেষণ করবো পলাশীর ঘটনাপ্রবাহ ও তৎপ্রসূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায়।



ইংরেজদের আগমন বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্য বিস্তার
বণিক শ্রেণীই হলো প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের অগ্রদূত। অন্যান্য জায়গার মত বাংলা ভাষা দক্ষিণ এশিয়ায়ও প্রথমে আসে বণিক শ্রেণী। এই বণিক শ্রেণীই মোগল শক্তিকে পরাহত করে স্থাপন করে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। ১৫৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জনৈক টমাস স্মাইথের সভাপতিত্বে আশিজন অংশীদার নিয়ে গঠিত হয় প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। প্রারম্ভিক পুঁজিমাত্র ত্রিশ হাজার পাউন্ড। ১৬০০ সালে কোম্পানির রয়্যাল চার্টার লাভের পর পরই ভারতে বাণিজ্যে অবতরণ করেনি। প্রথমে কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল দূরপ্রাচ্যের মসলাসমৃদ্ধ দ্বীপসমূহে ব্যবসা করা। ব্যর্থ হয়ে তারা ভারত বাণিজ্যে মনোনিবেশ করে। ১৬১৩ সালে কোম্পানির প্রথম বাণিজ্যকুটি স্থাপিত হয় ভারতের পশ্চিম উপকূল বন্দর সুরাটে। এর দীর্ঘ ২০ বছর পরঅর্থাৎ ১৬৩৩ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সঙ্গে নামে মাত্র বাণিজ্য যোগাযোগ শুরু করে। এ দেশের সঙ্গে কোম্পানির বাণিজ্য যোগাযোগ স্থাপনের প্রথম ২০ বছর অতিবাহিত হয় অনিশ্চিত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে। এমনকি কয়েকবার বাণিজ্য বন্ধ করে দেবারও প্রস্তাব করা হয়। অবশেষে ১৬৫০ সালে কোম্পানি বাংলায় ব্যবসা প্রসারের চূড়ান্ত সিদ্ধন্ত গ্রহণ করে এবং সে উদ্দেশ্যে বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলীতে ১৬৫১ সালে তাদের প্রথম বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। শুরু হয় বাংলায় ইংরেজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার কাজ। হুগলীতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের পর প্রথম কয়েক বছর ইংরেজদের ব্যয় হয় এদেশে বাণিজ্য সম্ভাবনা সন্ধানে। সন্ধান শেষে ফেক্‌টরসগণ কোর্ট অব ডাইরেক্টরসকে লিখেন, ‘বাংলাদেশ সমৃদ্ধিশালী প্রদেশ। এখানে কাঁচা রেশমসূক্ষ্ম সুতীবস্ত্রসেরা (Salt-petre) প্রচুর এবং সস্তায় পাওয়া যায়। আমাদের ব্যবসা এখানে এত লাভজনকভাবে চলছে যেঅচিরেই আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করার প্রয়োজন হবে এবং নতুন গুদামঘর স্থাপন করতে হবে। [John Bruce. Annals of the Honorable East India Company (London. 1840) Vol.1. Page 588] ১৬৫৭ সালে বাংলায় পৃথক এজেন্সী প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ঠিক শত বছর পর সংঘটিত হয় পলাশীর যুদ্ধ এবং প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশে কোম্পানির রাজত্ব। এই শত বৎসরে (১৬৫৭-১৭৫৭শত সহস্র ঘটনা রচনা করে অনুষ্ঠিত হয় যে পলাশীর নাটকতা সিরাজদ্দৌলার পতনের শেষ দৃশ্যমাত্র। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দশক থেকে বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ বিস্ময়করভাবে বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক কারণেই এর সাথে বৃদ্ধি পায় কোম্পানির রাজনৈতিক স্বার্থও। কেননাঘনিষ্ঠভাবে অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। তাছাড়া এটা জানা যেআধুনিক উপনিবেশবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বণিকশ্রেণী। বণিকবেশে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি কিভাবে ধীরে ধীরে এশিয়া ও আফ্রিকায় রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেভারতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এর একটি আদর্শ উপমা।


দ্বন্দ্ব প্রবঞ্চক কোম্পানি বনাম সরকার :
একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞায় ইংরেজরা প্রথম থেকেই নানা ছল-চাতুরীমিথ্যা প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার দাবি করে। সম্রাট শাহজাহান বাৎসরিক তিন হাজার মুদ্রা পেশকাশ বা পুরস্কার দানের বিনিময়ে অযোধ্যাআগ্রা প্রভৃতি প্রদেশে রাহাদারী অর্থাৎ পৃথক করমুক্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দেন ইংরেজদের। পরে শাহ সুজা বাংলায় বিনা শুল্কে ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার দেন (১৬৫১)। তখন সবেমাত্র এ দেশে কোম্পানির বাণিজ্য শুরু। পণ্য বেচাকেনায় কোম্পানির বিনিয়োগ এত সামান্য ছিল যেনগদ তিন হাজার টাকাকে শুল্কের চেয়ে শ্রেয় গণ্য করেন অদূরদর্শী সুজা। পরবর্তীতে কোম্পানির ব্যবসা যখন বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়সরকার চেষ্টা করে তাদের উপর শুল্ক প্রয়োগ করতে। কারণকোম্পানির শুল্কমুক্ত ব্যবসার ছত্রছায়ার কর্মচারি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও শুল্কমুক্ত রাখতে প্রয়াস পায়। সরকারের রাজস্ব বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ নিয়ে সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৬৭৭ সালে কোম্পানির সুরাটস্থ প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আউঙ্গিয়ার কোর্ট অব ডাইরেক্টরসকে জানানভারতে কোম্পানির বাণিজ্য এমন শোচনীয় অবস্থায় পরিচালনা করতে হচ্ছে যেএখানে কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করতে হলে প্রয়োজন একহাতে ব্যবসাআরেক হাতে তরবারী। নচেৎকোম্পানির অবস্থা দিন দিন আরো শোচনীয় হয়ে উঠবে এবং দূর্গ তৈরি করে প্রতিরক্ষায় ব্যবস্থা শক্ত না করলে অচিরেই এদেশ থেকে বিতাড়িত হতে হবে [Original Correspondence, 22 January 1677, No 4258, Vol. 37; Hedge' Diary, Vol-1, page. 133-34]। কোর্ট অব ডাইরেক্টরস ভারতে, Page. যুদ্ধ ও শান্তির ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করে বৃটিশ পার্লামেন্ট থেকে এবং ভারতে প্রেরণ করে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী। শান্তি পূর্ণ ব্যবসার পরিবর্তে ১৬৮৬ সালে কোম্পানি যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৬৯০ সালে কোম্পানি আওরঙ্গজেবের কাছে ক্ষমা মার্জনা,যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ এবং অন্যায়ভাবে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড জরিমানা দেবার শর্তে কোম্পানি এদেশে বাণিজ্যের অনুমতি লাভ করে।

কোম্পানির জমিদারী লাভ এবং রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ :
স্থানটিতে কুঠি স্থাপনের পর থেকে কোম্পানির নিয়ত চেষ্টা ছিল কুঠির আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের উপর জমিদারী স্বত্ব লাভ করে সেখানে একটি স্থায়ী সুরক্ষিত বসতির ব্যবস্থা করা। ১৬৯৫ সালে শোভা সিংহ ও রহিম খানের বিদ্রোহের ফলে আইন শৃঙ্খলার এমন শোচনীয় পতন ঘটে যেসুবাদার ইব্রাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭বিচলিত হয়ে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অনুমতি দেন তাদের স্ব স্ব প্রধান কুঠিতে দূর্গ স্থাপন করে নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিজেরা গ্রহণ করতে। এ সুযোগে কোম্পানি সুতানুটি কুঠিতে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ প্রতিষ্ঠা করে এ দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের প্রথম খুঁটি স্থাপন করে। বিদেশীদের জমিদারী সনদ দান মোগল শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী কিছু ছিল না। নবাব সরকারি রাজস্ব দানের শর্তে উক্ত তিনটি গ্রামের জমিদারী সনদ কোম্পানিকে অর্পণ করেন (১৬৯৮)। কোম্পানি জমিদারী লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশের জমিদার শ্রেণীর মধ্যে একজন হিসেবে অন্যান্য জমিদারদের মত কোম্পানিও লাভ করল জমিদারী শাসনের সব ক্ষমতা। জমিদারী লাভের মাধ্যমেই কোম্পানি দেশীয় রাজনীতিতেও অনুপ্রবেশ করে। তিনটি গ্রাম থেকে আস্তে আস্তে সমগ্র দেশই কোম্পানিরজমিদারীতে পরিণত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে কোম্পানি কর্তৃক বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দিওয়ানী লাভবস্তুত ১৬৯৮ সনের জমিদারী স্বত্বেরই পূর্ণ বিকাশ মাত্র।
দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং কোম্পানির রাজনৈতিক অভিলাষ :
কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে আসেনি। শান্তিপূর্ণ উপায়ে লাভজনক বাণিজ্য করাই ছিল ইংরেজদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এদের রাজনৈতিক আকাঙক্ষা জাগে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের প্রভাবে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭পর পরই শুরু হয় মোগল সাম্রাজ্যের পতন প্রক্রিয়া। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে শুরু হয় আন্তঃ প্রদেশ দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতিযোগিতা। প্রাদেশিক সরকারের অভ্যন্তরেও শুরু হয় ক্ষমতার কোন্দল। এপরিস্থিতিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি আগের মত নির্লিপ্ত থাকতে পারেনি। তাদের মধ্যেও জাগে রাজনৈতিক অভিলাষযার পরিণতি পলাশী ও পরিশেষে ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন।

কোম্পানি-নবাব সম্পর্কে অবনতি :
ইউরোপে অস্ট্রীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে (১৭৪০-৫৬ইংরেজ ও ফরাসিরা ছিল পরস্পর বিবাদমান। স্বাভাবিক কারণেই এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে অবস্থানরত ইংরেজ-ফরাসিরাও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আলিবর্দী খান বঙ্গে অবস্থানরত ইংরেজ ও ফরাসি উভয় জাতিকেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার আশ্বাস দেন এবং দূর্গ নির্মাণ তৎপরতা থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের হুঁশিয়ার করে দেন। ফরাসিরা নবাবের আহবানে ইতিবাচক সাড়া দিলেও ইংরেজরা সুজা সরকারকে জানিয়ে দেয় যেকোম্পানির স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনে যে কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করবে না। নবাবের পুনঃ পুনঃ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কলকাতাকে সুরক্ষিত করার জন্য কোম্পানি সিদ্ধান্ত নেয়। কলকাতা সুরক্ষিত করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পলাশী যুদ্ধের প্রধান প্রত্যক্ষ কারণের উম্মেষ।

মহাষড়যন্ত্র ও পলাশীর যুদ্ধ :
মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভের বাংলা অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমতসিরাজদ্দৌলার পতন ঘটিয়ে বাংলার মসনদে একজন ইংরেজ অনুরাগী বসানো যেন বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়দ্বিতীয়তবাংলাদেশে থেকে ফরাসি প্রভাব নিশ্চিহ্ন করা। এ দুই উদ্দেশ্য সাধন করতে যত রকম বিশ্বাসঘাতকতাহঠকারিতা ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়তা নিতে নির্দেশ দেয়া হয় ক্লাইভকে। ১৭৫৭ সালে ফরাসিদের নিঃশক্তি করার পর ক্লাইভের পরবর্তী চেষ্টা ছিল নবাবের বিরোধী দলের সঙ্গে আঁতাত করা। বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেয় জগৎশেঠ পরিবার। মীরজাফরঘষেটি বেগম,শওকত জং-এর সমর্থকগণ ছিলেন সিরাজবিরোধী। এসব বিরোধীদের সংঘবদ্ধ করে সিরাজকে উৎখাত করার একটি ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করেন ক্লাইভ। ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হয়বিকেল চারটায় নবাবের সৈন্য পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করে। যুদ্ধে নবাবের ছিল ১৫০০০ অশ্বারোহী সৈন্য৩৪০০০ পদাতিক সৈন্যযুদ্ধ হাতী ও চল্লিশটি কামান। আর ক্লাইভের অধীনে ছিল মাত্র ৩২০০ ইউরোপীয়ান ও দেশীয় সৈন্য ও আটটি কামান। কিন্তু যুদ্ধে নবাবের সৈন্যের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র অংশগ্রহণ করে। মীর জাফরের ইঙ্গিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে বেশির ভাগ সৈন্য। নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন বুঝতে পারেন তিনি এক মহাচক্রান্তের শিকার এ পলাশীর ময়দানেতখন দেরী না করে তিনি দ্রুত পলায়ন করেন। তাঁর সংকল্প ছিল বিহারে অবস্থানরত তাঁর অতি অনুগত রামনারায়নের বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করে আবার তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। কিন্তু সে বাসনা তাঁর পূরণ হয়নি। দুর্ভাগা সিরাজ পথিমধ্যে ধৃত হন এবং ২ জুলাই মুর্শিদাবাদে নিহত হন। এমনিভাবেই অবসান হয় অর্ধশতাব্দীর স্বাধীন নবাবি যুগের।

অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় বিদেশীদের যোগদান ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব :
বার্ষিক থোক তিন হাজার টাকা পেশকাশের বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করেছিল। কিন্তু সে অধিকার ছিল শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে পণ্য কেনাবেচা করার অধিকার বিদেশি বণিকদের ছিল না। কিন্তু চোরাইভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত ব্যবসা করতো এবং সে ব্যবসায় অনেক সময় কোম্পানির দস্তক (বিনা শুল্কে বাণিজ্য পাশব্যবহার করতো। কোম্পানির লোকদের অবৈধভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে যোগদান ছিল সুবা সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতির অন্যতম কারণ। পলাশীর পর কোম্পানির লোকদের দাপট এমন বেড়ে যায় যেদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তারা অবাধে যোগদান করে এবং সে বাণিজ্যের জন্য তারা সরকারকে শুল্ক দিত না। কিন্তু দেশী বণিকদের শুল্ক দিতে হতো বলে অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ে দেশী ব্যবসায়ীরা উৎখাত হবার উপক্রম হলো। ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে কোম্পানির লোকেরা রাতারাতি ক্রোড়পতিতে পরিণত হলো। কোম্পানির কর্মচারীদের পরিচালিত ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিগত ব্যবসাই নবাব মীর কাশিমকে বাধ্য করেছিল কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। কিন্তু তিনি পরাজিত হন। মীর কাশিমের পরাজয়ের পর কোম্পানির কর্মকর্তাদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হলো Society of trade। একষট্টি সদস্যের এ লুণ্ঠন সমিতি লবণসুপারিতামা প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একচেটিয়া বাণিজ্য কুক্ষিগত করলো। অন্যান্য কর্মকর্তারা অনুরূপ আনুষ্ঠানিক সমিতি গঠন না করলেও কার্যতবলপ্রয়োগ করে তারা সারা দেশে চালাল বাণিজ্যের নামে লুটপাট। কোম্পানির এ লুণ্ঠনযজ্ঞের পরিণতিতে দেশের অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর রূপ ধারণ করে অবশেষে এক মহাদুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে নিপতিত হলো (১৭৬৯-৭০ খ্রিঃ১১৭৬ বঙ্গাব্দ)। দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায় এবং কৃষিশ্রমের অভাবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি অনাবাদী জঙ্গলভূমিতে পরিণত হয়। আর্থিক দিক থেকে পলাশী ছিল কোম্পানির জন্যও পরাজয়। পলাশী যুদ্ধের পর দুর্নীতিপ্রশাসনিক ব্যয়বৃদ্ধি ও ঘন ঘন যুদ্ধ ঘোষণার জন্য ক্রমশই কোম্পানির বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড সংকীর্ণ হতে থাকে। কোম্পানি শাসকে পরিণত হবার পর প্রথম প্রথম বাণিজ্যে অবহেলিত না হলেও অচিরেই শাসনে অগ্রাধিকার লাভ করলো। অল্পকালের মধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে কোম্পানি একটি অলাভজনক সংস্থায় পরিণত হয়। বাংলায় রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের প্রকৃত মুনাফা লাভ করে ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির কর্মকর্তারা। পলাশীর আগে কোম্পানি প্রতি বছর শেয়ারহোল্ডারদের আকর্ষণীয় মুনাফা ঘোষণা করত। কিন্তু পলাশীর পরই কোম্পানি প্রায় দেউলিয়ায় পরিণত হয়। এদিকে সুবার অর্থনীতিও ভেঙে পড়লো। অর্থাৎ পলাশীর অব্যবহিত ফল ছিল একদিকে বাংলার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনীতির পতন অপরদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
পলাশীর ট্রাজেডি
সুদূর প্রসারী ফল রাজনৈতিক তাৎপর্য :
পলাশী যুদ্ধ ঘটেছিল বাণিজ্যিক কারণে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে যোগদান করতে এসেছিল আর্মেনীয়পর্তুগীজওলন্দাজফরাসি ইংরেজ বণিকেরা। স্থাপন করেছিল তারা স্থানীয় শাসক ও বণিক শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্ক। অচিরেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ঐ সম্পর্কে। সে দ্বন্দ্বেরই নিরসন চেষ্টা ছিল পলাশী। কিন্তু পলাশী-ঘটনারাজি আর বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। বাণিজ্য রূপান্তরিত হলো রাজনৈতিক আধিপত্যবাদে। স্থাপিত হলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। বাংলা থেকে সমগ্র ভারতে এবং ভারত থেকে সমগ্র ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। সন্দেহ নেই যেপলাশী একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এতকাল যাবৎ সে সরকার পদ্ধতিযে শাসন ব্যবস্থাযে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনায় অবদান রেখেছেপলাশী এসব প্রতিষ্ঠানের ইতি ঘোষণা করলো এবং ভিত্তি রচনা করলো নতুন প্রতিষ্ঠানেরব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের। সে রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটেছে ঔপনিবেশিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রয়োজন ছিল হাজার বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনধারায় গড়ে উঠা বঙ্গরাজ্যকে ভারত রাজ্য তথা ভারত সাম্রাজ্যে রূপান্তর করা। তবে এ রূপান্তরে বাংলার আবহমান আঞ্চলিক গুরুত্ব লাঘব হয়নি। সুবা বাংলা ছিল মুগল সাম্রাজ্যের মুকুট। তেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরও মুকুট ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী। ভালো হোক আর মন্দই হোকবাংলায় এ রূপান্তর ছিল পলাশীরই সুদূরপ্রসারী ফল। নতুন শাসন ব্যবস্থাবিচার ব্যবস্থাপুলিশচিরস্থায়ী বন্দোবস্তপাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাস্থানীয় শাসন ব্যবস্থাআমলাতন্ত্রজনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানাদিউন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অনুরূপ আরো অনেক আধুনিকীকরণ-পরিবর্তন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের দানযা ছিল পলাশী থেকে উৎসারিত। এসব পরিবর্তনকে ভিত্তি করে অনেক পণ্ডিত মনে করেন যেপলাশী যুদ্ধোত্তর ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের জন্য পরম সুফল বয়ে এনেছিল। স্যার যুদনাথ সরকার যেমন মন্তব্য করেনএদেশের ইতিহাস ‘ধীরে ধীরে এবং অলক্ষ্যে (পলাশী যুদ্ধআনয়ন করলো এমন একটি গৌরবময় প্রভাতযা কিনা বিশ্ব-ইতিহাসের অন্য কোথাও বিলক্ষণ করা যায় না। ২৩ জুন১৭৫৭ তারিখে অবসান ঘটলো ভারতের মধ্যযুগের এবং সূত্রপাত হলো আধুনিক যুগের।...পলাশীর পর এক প্রজন্মের কম সময়ের মধ্যেই দেশ এর মধ্যযুগের ধর্মদুষ্ট শাসনের পক্ষাঘাত থেকে নিরাময় লাভ করতে শুরু করলো। শিক্ষাসাহিত্যসমাজধর্ম রাজনীতি সব কিছুর মধ্যেই জোয়ার আসল পাশ্চাত্যের নব প্রেরণায় ও স্পর্শে। বিধাতাদত্ত এক যাদুকরের যাদুকাঠির ছোঁয়ায় যেন স্থবির প্রাচ্য সমাজের শুকনো হাড়ে দেখা দিল জীবনের স্পন্দন। এ ছিল এক সত্যিকারের রেনেসাঁ। এ রেনেসাঁ কনস্তান্তিনোপল পতনোত্তর ইউরোপীয় রেনেসাঁর চেয়েও ব্যাপকগভীর ও বৈপ্লবিক। কনস্তান্তিনোপল পতনের সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সংযোগ রয়েছে। স্যার যদুনাথ সরকারের মতে পলাশী পতনও অনুরূপ একটি রেনেসাঁ সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়সে পলাশী-উত্তর ‘রেনেসাঁ’টি ছিল কনস্তান্তিনোপলোত্তর রেনেসাঁর চেয়েও ‘ব্যাপকগভীর ও বৈপ্লবিক’। বলাই বাহুল্যপলাশীর সুফল বর্ণনা করতে গিয়ে স্যার যদুনাথ সরকার ভাবলুতাঅতিরঞ্জনঅত্যুক্তিঅপ্রমাণিত বিবৃতির আশ্রয় নিলেনযা কিনা বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিকদের সচেতনভাবে পরিহার করতে হয়। ক্লাইভ থেকে কর্নওয়ালিস-এর আগমন পর্যন্ত কোম্পানির কর্মকর্তারা বাংলার উপর যে পাশবিক অত্যাচারলুণ্ঠনসম্পদ পাচার ঘটিয়েছে তার লোমহর্ষক তালিকা ব্রিটিশ পার্লামেন্টই তৈরি করেছে। পার্লামেন্টের নিকট এর কিছুটা কৈফিয়ত ক্লাইভ ও হেস্টিংসকে দিতে হয়েছে। কপর্দকহীন অবস্থায় বাংলায় এসে অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নবাব হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করার কাহিনী সমকালীন ব্রিটিশ সাহিত্যে ভরপুর। ক্লাইভ এর প্রণীত দ্বৈত সরকার (১৭৬৫-১৭৭১ছিল বস্তুত সরকারহীনতা। দ্বৈত সরকারের দান অরাজকতাইংরেজের লাগামহীন অত্যাচার ও সম্পদ পাচার এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরযার কবলে পড়ে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি হয় জঙ্গলাকীর্ণ। হেস্টিংস এর শাসনামলে নিলামি ভূমিরাজ স্বর্ব্যবস্থায় জমিদার ও রায়ত শ্রেণী উভয়ই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অভিঘাতে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত আকালঅনটনদুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে প্রায় প্রতি বছর। এ সময়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত ও ইজারাদারনিপীড়িত রায়তশ্রেণীর বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ ব্রিটিশ শাসনের জন্য ছিল এক বড় উদ্বেগের বিষয়। এসব কিছুকে উপেক্ষা করে যদুনাথ সরকার মন্তব্য করেন যেপলাশীর পর এক প্রজন্মের কম সময়ের মধ্যেই পাশ্চাত্যের স্পর্শে বাংলা অগ্রগতির মুখ দেখল। বাস্তবতার নিরিখে এ মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তেমনি গ্রহণযোগ্য নয় তাঁর তথাকথিত রেনেসাঁ তত্ত্বও। স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, ‘পলাশীর-উত্তর বঙ্গীয় রেনেসাঁ কনস্তান্তিনোপল পতনোত্তর ইউরোপীয় রেনেসাঁর চেয়েও ব্যাপকগভীর ও বৈপ্লবিক’। ইউরোপীয় রেনেসাঁ কি রূপান্তর ঘটায় আমাদের জানা। কিন্তু আমাদের নেই যদুনাথ সরকারের বর্ণিত পলাশী পতনোত্তর রেনেসাঁ বাংলা তথা ভারতের কী রূপান্তর ঘটাল। আমরা জানিকর্নওয়ালিসের পর থেকে প্রশাসনকে সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গকরণ করা হলোশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাহৃত হলো চিরাচরিত সরকারি অনুদান (লাখেরাজ); চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার তার নিরাপত্তা হারিয়েছেরায়ত হারিয়েছে তার অধিকার। আমরা আরো জানি যেঊনিশ শতকে ধর্মীয় জাগরণ ঘটেছে এবং অন্যান্য কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাগরণ সৃষ্টি করেছে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বরাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশী মানুষের লক্ষ্যণীয়ভাবে অনুপ্রবেশ ঘটলো মাত্র বিশ শতকে এসে। ১৯৪৭ সনে ভারতের কোন অঞ্চলের সাক্ষরতাই দশ শতাংশের উপরে ছিল না। মাথাপিছু আয় ছিল বিশ্বের সর্বনিম্নের কাছাকাছি। বর্ণজাতিঅস্পৃশ্যতা ছিল দাপটের সহিত বিদ্যমান।

উপসংহার :
অনেকে যুক্তি প্রদান করেন যেব্রিটিশ শাসনের ফলেই বাংলা তথা ভারত আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে পেরেছে। তবে সে সংস্পর্শ লাভ কি পার্থক্য সৃষ্টি করলোঊনিশ শতকে ব্রিটেনের মানবসম্পদ বৃদ্ধি ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। ভারত ব্রিটেনের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও কেন এখানে অনুরূপ রূপান্তর ঘটলো নাঔপনিবেশিক শাসনাধীনে মানবসম্পদ বৃদ্ধি পেতে পারে না। কারণঔপনিবেশিক শাসন স্থাপিত হয় নিজ জাতির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যবিজিত জাতির মনবোন্নয়নের জন্য নয়। ক্লাইভহেস্টিংসওয়েলেসলিডালহৌসী এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন এদেশবাসীর রূপান্তর ঘটানোর জন্য নয়এদেশের সম্পদ আহরণ করে স্বদেশের সুবিধার জন্যযেজন্য শাসক এক হওয়া সত্ত্বেও এক জায়গায় রূপান্তর ঘটেআরেক জায়গায় ঘটেনা।

গ্রন্থ সহায়িকা :
(বাংলার ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো (১৭৫৭-১৮৫৭সিরাজুল ইসলাম, (বাংলার ইতিহাস (মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত) {১২০০-১৮৫৭ খ্রি:} আবদুল করিম, (বাংলাদেশ ও পাক-ভারতের ইতিহাস (প্রাচীনমধ্য ও আধুনিক যুগঅধ্যাপক কে আলী, (ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্য-আধুনিক যুগহাসান আলী চৌধুরী।