07 March 2016

একাধিক বানানরীতির কবলে ধর্মীয় শব্দ


দ্বীন বহুল প্রচলিত একটি আরবি শব্দ। বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান অনুযায়ী তা লিখতে হয় দিন। আর বাংলা ভাষায় আগে থেকেই দিন শব্দ রয়েছে, যার অর্থ দিবস। আবার অনেকে এ অসুবিধা বিবেচনা করে লেখেন দীন। কিন্তু দীন শব্দও আগে থেকেই বাংলা ভাষায় আছে, যার অর্থ হলো দরিদ্র, করুণ ও হীন। এ অবস্থায় এ আরবি শব্দের জন্য এ দুটি বানানের যেটিই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা-ই হবে বিভ্রান্তিকর।



প্রতিটি ভাষায়ই ভিন্ন ভাষার শব্দের সংমিশ্রণ ঘটে। এতে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। বাংলা ভাষায়ও বিভিন্ন ভাষার শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। আরব, ইয়েমেন, ইরান ও তুরস্ক থেকে আগত আরবি-ফারসি ভাষা জানা ইসলাম প্রচারকরা বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। এরপর স্থানীয় আঞ্চলিক উপভাষাগুলোর শব্দাবলির সঙ্গে আরবি ও ফারসি শব্দের সংমিশ্রণ ঘটে। ফারসি শব্দ বঙ্গালাহ্ দিয়ে এ ভাষার নামকরণ হয়েছে বাংলা ভাষা করে। (সূত্র : বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৮৪৬) এদিকে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণের কারণে বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বাংলা বানানে ঐক্য আনার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে। ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে বিশ্বভারতী চলতি ভাষার নিয়ম প্রণয়ন করে, যার সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানানের নিয়ম-এর পার্থক্য ছিল। এর পর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সট বুক বোর্ড ১৯৮৮ সালে, বাংলা একাডেমি ১৯৯২ সালে বানানরীতি প্রণয়নে উদ্যোগী হয়। এটি ১৯৯৮ সালে পরিমার্জিত হয়ে ২০০০ সালে পুনরায় সংশোধিত হয়। তার পরও বাংলা বানানে শৃঙ্খলা আসেনি। বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পৃথক বানানরীতি রয়েছে। এর বাইরেও আমরা দেখতে পাই একেক পত্রিকা একেক নিয়মে ভাষা ব্যবহার করছে। প্রথম আলোর নিজস্ব ভাষারীতি রয়েছে। অন্যদেরও আলাদা নিয়ম রয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, একই শব্দের বানান একেক পত্রিকা একেকভাবে লিখছে!

বাংলা একাডেমির বানানরীতি ও অভিধান নিয়ে কিছু কথা : বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতির মেধা ও মননের প্রতীক। যে ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা লড়াই করেছি, সেই ভাষার পরিচর্যা করার লক্ষ্যেই বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষার বেশ কয়েকটি অভিধান প্রকাশ করেছে। যেমন : বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ১৯৭৪), বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান (প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬), বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান (প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৪, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৮) ইত্যাদি। বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলা দূরীকরণই এসব অভিধানের মূল লক্ষ্য।
বাংলা একাডেমি তার বানানবিধিতে সংস্কৃতজাত নয় এমন শব্দের (যেমন : আরবি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে আগত) শব্দের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ-কার (ী) ও দীর্ঘ ঊ-কার ( ূ) তুলে দিয়েছে; কিন্তু সংস্কৃত উৎসজাত শব্দের ক্ষেত্রে তা বহাল রেখেছে। এর ফলে বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি, ইংরেজি শব্দাবলির বানান ও উচ্চারণ মূল ভাষার বানান ও উচ্চারণের প্রতিফলন থেকে অনেক ক্ষেত্রেই দূরে সরে গেছে। অথচ নীতিগতভাবেই যেকোনো ভাষায় বহিরাগত শব্দের ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব উৎসমূলের সঙ্গে সামঞ্জস্য ধরে রাখা উচিত। গবেষক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, শেকসপিয়ারের সমাধিলিপিতে লেখা ছিল ভত্বহফ, পাথরটাকে তাঁরা (ইংরেজ পণ্ডিতরা) বদলাতে পারলেন না; কিন্তু তাঁরা তা সংশোধন করে বললেন, ওটা হবে ভত্রবহফ। কারণ পণ্ডিতরা ঝোঁক দিয়েছিলেন ব্যুত্পত্তির ওপর। শব্দের ব্যুত্পত্তি দেখিয়ে তাঁরা বললেন, শব্দটা যখন লাতিন থেকে নেওয়া, সুতরাং বানানটাকে সেই মূল শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাক। আবার কোনো শব্দের মূল গ্রিক হলে সেই শব্দে গ্রিকের ছাপটা যেন সামান্য হলেও থাকে। যেমন : একসময় ইংরেজিতে ডেট (ঋণ) কথাটা লেখা হতো সোজা বানানেফবঃ। কিন্তু রক্ষণশীল গ্রিক-লাতিনবাদীরা বললেন, মূল শব্দটা যখন ফবনরঃঁস তখন ওটার চরিত্র রক্ষার জন্য লেখা হোক ফবনঃ; ঃত্ঁ-কে লেখা হোক ঃত্ঁব। কারণ ওর মূলে আছে ঃত্রববি...(দুখিনী বাংলা বানান, গোলাম মুরশিদ, প্রথম আলো, ৫-১০-২০১২)।

সংস্কৃতজাত নয় এমন শব্দের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ-কার (ী) ও দীর্ঘ ঊ-কার ( ূ) তুলে দেওয়ার সপক্ষে অনেককে যুক্তি উপস্থাপন করতে দেখা যায়। প্রথমত বলা হয়, বাংলা ভাষায় দীর্ঘ ঈ-কার (ী) ও দীর্ঘ ঊ-কার ( ূ)-এর উচ্চারণ নেই। তথ্য হিসেবে এ দাবি সঠিক। কিন্তু যুক্তি হিসেবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা সে ক্ষেত্রে সংস্কৃতজাত শব্দের বেলায়ও এটা প্রযোজ্য হওয়া উচিত। তা ছাড়া বাংলা ভাষাবিদরা বলে থাকেন, বাংলা বানান শ্রুতিনির্ভর নয়, স্মৃতিনির্ভর। (ড. মাহবুবুল হক, বাংলা বানানের নিয়ম, অষ্টম মুদ্রণ : মাঘ ১৪২০, জানুয়ারি ২০১৪, পৃ. ৩২) তাই উচ্চারণের যুক্তি এখানে গৌণ।
দ্বিতীয়ত, সংস্কৃত ভাষায় দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহার প্রসঙ্গে ড. মাহবুবুল হক লিখেছেন, সংস্কৃত ভাষায় ই এবং ঈ-এর উচ্চারণগত হ্রস্বতা ও দীর্ঘতা রক্ষিত হয় বলে বানান উচ্চারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমরা মনে করি, একই যুক্তিতে বিদেশি শব্দ বিশেষত আরবিতে দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহার করা উচিত। কেননা হ্রস্বতা ও দীর্ঘতা এ ভাষায় সবচেয়ে বেশি রক্ষিত হয়। তাহলে সেসব শব্দ যখন বাংলায় ব্যবহার করা হয় তখন সে নিয়ম রক্ষা করা উচিত নয় কি?
তৃতীয়ত, তিনি লিখেছেন, বিদেশি বানানের ক্ষেত্রে যদিও ই-কার ও ঈ-কার দুই-ই সিদ্ধ, তবু ভুল এড়ানো এবং বানান সরল করার উদ্দেশ্যে অধুনা এ ক্ষেত্রে কেবল ই-কার ব্যবহারের বিধি মেনে নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, ই-কার ব্যবহার করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ভুল এড়ানো যাবে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নতুনভাবে ভুলের বিস্তার ঘটবে। যেমন শত শত বছর ধরে মানুষ ব্যবহার করে আসছে : ইসলামী, নবী, আলী, শহীদ, গাজী প্রভৃতি শব্দ। অথচ বাংলা একাডেমির ভাষারীতি অনুসারে এগুলোর শুদ্ধরূপ হলো : ইসলামি, নবি, আলি, শহিদ, গাজি। এতে কেবল নতুন করে ভুলের সৃষ্টিই হচ্ছে না, বরং এই শব্দগুলো তার মূল আবেদন ও প্রাণ হারাতে শুরু করেছে। তা ছাড়া ভাষা সরল করার উদ্দেশ্য হলে অন্য শব্দের বেলায়ও এ বিধি (দীর্ঘ ঈ-কারকে হ্রস্ব ই-কার করা) প্রয়োগ করা দরকার। অথচ আমরা দেখতে পাই, স্ত্রীবাচক তৎসম শব্দের শেষে ঈ-কার হয়। যেমন : নারী, রমণী, সুন্দরী প্রভৃতি। স্ত্রীবাচক -ইনী প্রত্যয়ান্ত তৎসম শব্দের শেষে ঈ-কার হয়। সংখ্যাবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার হয়। ব্যক্তি বা পুরুষ বোঝাতে এবং বিশেষণবাচক তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ঈ-কার হয়।
বাংলা একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) বানানরীতির ক্ষেত্রে আরেকটি মৌলিক পার্থক্য দেখা যায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ফাউন্ডেশন যাল, সোয়াদ, যা প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। এসব অক্ষরযুক্ত শব্দ বাংলা ভাষায় অনেক। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলা একাডেমি ইসলাম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। যেমন : আযান, ওযু, নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান প্রভৃতি। কিন্তু আগ বাড়িয়ে প্রথম আলো নিয়ম করেছে : বিদেশি শব্দ ও নামের বানানে না লিখে লিখতে হবে। বর্তমানে মিডিয়া ও সাধারণ শিক্ষিতদের লেখায় তাদের অনুকরণ চোখে পড়ার মতো। অথচ স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় লেখকরা ইফার বানানরীতি অনুসরণ করে থাকেন। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী তো বলতেই শুরু করেছেন যে শুদ্ধ বাংলায় লেখা কোনো ধর্মীয় বই নাকি পাওয়া যায় না। এর ফলে ধর্মীয় লেখকরা বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। একাডেমির আরো বেশ কিছু নিয়মের কারণে মুসলমানদের শত শত বছর ধরে ব্যবহার করে আসা অনেক শব্দের কেবল অপপ্রয়োগই হয়নি, বিকৃতিও ঘটে। যেমন : দ্বীন বহুল প্রচলিত একটি আরবি শব্দ। বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান অনুযায়ী তা লিখতে হয় দিন। আর বাংলা ভাষায় আগে থেকেই দিন শব্দ রয়েছে, যার অর্থ দিবস। আবার অনেকে এ অসুবিধা বিবেচনা করে লেখেন দীন। কিন্তু দীন শব্দও আগে থেকেই বাংলা ভাষায় আছে, যার অর্থ হলো দরিদ্র, করুণ ও হীন। এ অবস্থায় এ আরবি শব্দের জন্য এ দুটি বানানের যেটিই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা-ই হবে বিভ্রান্তিকর। যদি বলা হয়, দিনের কাজ করো, তাহলে কেউ মনে করতে পারে যে তাকে রাতের কাজ (ইঙ্গিতবাচক অর্থে চুরি) করতে নিষেধ করা হচ্ছে। আর যদি বলা হয় দীনের খেদমত করো, তাহলে সে মনে করতে পারে, তাকে দরিদ্রদের সেবা করতে বলা হয়েছে। সুতরাং ইসলাম ধর্ম অর্থে দ্বীন লেখাই শ্রেয়। বাংলায় রাসুল শব্দটি কয়েকভাবে ব্যবহূত হয়। যেমন : রাসূল, রাসুল, রসূল, রসুল। বাংলা একাডেমি এ ক্ষেত্রে রসুলকে প্রাধান্য দিয়েছে। কোরআন শব্দটিরও একাধিক ব্যবহার দেখা যায়। যেমন : কোরান (বাংলা একাডেমি মতে), কুরআন, কুরআন, কোরআন ইত্যাদি। আবার হজ (বাংলা একাডেমি মতে), হজ্ব, হজ্জ, হজ্জ্বসব রকম ব্যবহার দেখা যায়। আমাদের প্রিয় নবীর নামটিও এই বহু ব্যবহার-এর কবল থেকে রক্ষা পায়নি। যেমন : মুহম্মদ (বাংলা একাডেমি মতে), মুহাম্মদ, মুহাম্মাদ, মোহাম্মদ, মোহাম্মাদ ইত্যাদি ব্যবহার দেখা যায়। যেসব শব্দের শব্দমূল আরবি, সেগুলো আরবি রীতিতে লেখা বাঞ্ছনীয়। তাই নিয়ামত, মোকাবিলা, মুশকিল ইনকিলাব প্রভৃতির ব্যবহার যথার্থ, যেমনটা একাডেমি করেছে। সে হিসেবে মোমিন-এর চেয়েও মুমিন ব্যবহার করা উত্তম। শেখ শব্দের ক্ষেত্রে একাডেমি শয়খকে কেন প্রাধান্য দিয়েছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। ঈদ যদি দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লেখা যায়, তাহলে ঈমান লিখতে অসুবিধা কোথায়? মুসলমানদের জীবনে ঈদ আসে বছরে দুইবার। আর দিনের ২৪ ঘণ্টাই মুসলমানদের ইমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বাংলা ভাষায় আলী, শাফেয়ী ইমাম মেহদী শব্দ তিনটির চেয়েও শহীদ, নবী শব্দ দুটি বেশি ব্যবহূত হয়। অথচ বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-শহিদ নবি হ্রস্ব ই-কার করে আলী, শাফেয়ী ইমাম মেহদী দীর্ঘ ঈ-কার করা হয়েছে। আরোগ্য বোঝাতে শিফা বা শেফা শব্দটি বহুল পরিচিত। অথচ এর বানানে একাডেমি লিখেছে শাফাগায়ের মুকাল্লিদ লেখা সম্ভব হলে গায়র মহরম-এর প্রতি অবিচার কেন? ইনশা আল্লাহ আলাদা লেখা হলে এর অর্থ হয় আল্লাহকে সৃষ্টি করো। নাউজুবিল্লাহ! তাই শব্দটিকে একত্রে ইনশাআল্লাহ বা ইন শা আল্লাহ লিখতে হবে। বিষয়গুলো বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা মনে করি, বাংলা একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের একত্রে বসে অভিন্ন ভাষারীতি প্রণয়ন করা সময়ের দাবি। অন্তত ইসলাম ধর্মসংশ্লিষ্ট শব্দগুলোর ক্ষেত্রে অভিন্ন লিখন পদ্ধতি প্রণয়ন জরুরি। উভয়টি যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই তাদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ার কারণ নেই। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু স্থানাভাবে আমাদের এখানেই থামতে হচ্ছে।


No comments:

Post a Comment