22 May 2020

বায়তুশ শরফের পীর আল্লামা কুতুব উদ্দিন (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী


বায়তুশ শরফের পরম শ্রদ্ধাভাজন পীর আল্লামা শাহ্সূফি হযরত মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

গত ২০ মে, বুধবার ২০২০ ইং. ঢাকার ধানমন্ডি ডা. আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮২ বছর বয়সে শাহসূফি হযরত মওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজেউন। পরদিন ২১ মে, বৃহস্পতিবার বা’দ ফজর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বায়তুশ শরফ মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তাঁরই একমাত্র ছেলে জনাব মাওলানা মোহাম্মদ ছলাহ উদ্দিন বেলাল। হুজুরকে তাঁরই পীর মুর্শিদ মরহুম হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) এর পাশে সমাহিত করা হয়।

তিনি ছিলেন এক কালজয়ী প্রতিভা। জ্ঞানে গুণে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও আরবি ভাষাবিদ হিসেবে তিনি সর্বজন প্রশংসিত। তাঁর কাব্যিক প্রতিভাও অসাধারণ। বিখ্যাত ওয়ায়েজ বা বক্তা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক উচ্চে। এরূপ বড় বড় পরিচয়, খ্যাতি ছাড়িয়ে তিনি একজন কামিল পীর হিসেবেই সর্বত্র পরিচিত। মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও ওলি হিসেবে সর্বশ্রেণির লোকের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র। একই সাথে ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, দেশ দরদি এবং সমাজসেবক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে সমধিক। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

জন্ম ও বংশ পরিচিতি :
মওলানা শাহ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন উপমহাদেশব্যাপী পরিচিত দক্ষিণ-পূর্ব ‘বাংলার’ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের অদূরে বৃহত্তর সাতকানিয়া (বর্তমান লোহাগাড়া) উপজেলার অন্তর্গত আধুনগরস্থ সুফি মিয়াজি পাড়ায় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে এক ঐতিহ্যবাহী, সম্ভ্রান্ত ও আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মওলানা মরহুম মুসলেহ উদ্দিন এবং মাতা মরহুমা রাইহানাহ বেগম। তাঁর পিতা ছিলেন লোহাগাড়া থানাধীন ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার একজন সুযোগ্য শিক্ষক। তাঁর মাতা চরিত্রবতী, পর্দানশীন অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিলেন।

শিক্ষাজীবন :
মওলানা শাহ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন যেহেতু শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, তাই ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, তীক্ষè মেধাবী ও চিন্তাশীল ছিলেন। চার বৎসর বয়সেই স্বীয় মাতার কাছে হরফে আওয়াল তথা প্রথম অক্ষরের শিক্ষা লাভ করেন এবং পিতার কাছে আরবি-ফারসি-উর্দু-বাংলা ইত্যাদির প্রাথমিক পাঠ সমাপন করেন। তিনি মাতা-পিতার একমাত্র সন্তান হিসেবে আলালের ঘরের দুলাল ছিলেন। অতঃপর তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র (বর্তমানে কামিল) মাদরাসায় ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। কোন কিছু তাঁর চোখের সামনে একবার পড়লে তা আর ভোলেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি অতি প্রখর ছিল। যার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র মাদরাসার সেরা মেধাবী ছাত্রদের তালিকায় উচ্চমার্গে স্থান করে নেন। এ মাদরাসা থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে হাফতুম (দাখিল) কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ছাত্র জীবনের একান্ত সহপাঠী প্রফেসর ড. শব্বির আহমদ (১৩৫৭ হি./ ১৯৩৮ খ্রি.- ১৪৩৮ হি./ ২০১৬ খ্রি.) বলেন, “জমাতে ‘হাফতুম’ এর সরকারি পরীক্ষায় মন্দ ফলাফল বন্ধু বৎসল ও চিত্তহারী এ বালকের সাথে মানানসই না হওয়ায় জমাতে ‘শুসুম’ এ তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে, তখন থেকেই তিনি শ্রেণি পরীক্ষায় ঈর্ষাযোগ্য আসন লাভ করতে থাকেন।”

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে একই প্রতিষ্ঠান হতে ছুয়াম (আলিম) ১ম বিভাগে ১৬শ স্থান এবং ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে উলা (ফাযিল) ১ম বিভাগে ৫ম স্থান অধিকার করে বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র মাদরাসায় তাঁর উস্তাদদের মধ্যে মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের (১৩৪১ হি./১৯২২ খ্রি.-১৪০৬ হি./ ১৯৮৫ খ্রি.), মওলানা মোজাফফর আহমদ (১৩২২ হি./ ১৯০৪ খ্রি.-১৩৯১ হি./ ১৯৭১ খ্রি.), মওলানা মুহাম্মদ আমীন (মৃ. ১৪২০হি./ ১৯৯৯ খ্রি.), মওলানা রশিদ আহমদ (১৩৩৯ হি./ ১৯২০ খ্রি.- ১৪৩৪ হি./ ২০১২ খ্রি.), মওলানা মুহাম্মদ কাসেম (১৩৪৬ হি./ ১৯২৭ খ্রি.-১৪৩৩ হি./ ২০১১ খ্রি.) ছিলেন অন্যতম।

উচ্চ শিক্ষা ও কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল :
হাদিস বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল মাদারিস (মাদরাসা সমূহের জননী) খ্যাত চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। এ মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিনি ‘কালের সেরা ছাত্র’ ও ‘মাদরাসার গৌরব’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কামিল (হাদিস) ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করায় ‘গোল্ড মেডেল’ লাভ করেন। এ ঈর্ষণীয় ফলাফল লাভের সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তাঁকে দু’বৎসর সময়কাল গবেষণা করার জন্য বৃত্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন নি। দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় তাঁর উস্তাদদের মধ্যে প্রিন্সিপ্যাল মওলানা ফজলুর রহমান (১৩০৪ হি./ ১৮৮৬ খ্রি.-১৩৮৪ হি./ ১৯৬৪ খ্রি.), ফখরুল মুহাদ্দেসিন মওলানা মুফতি মুহাম্মদ আমীন (১৩২৩ হি./ ১৯০৫ খ্রি.-১৩৮৯ হি./ ১৯৭৭ খ্রি.), মওলানা আবুল ফছীহ মুহাম্মদ ফুরকান (১৩২৮ হি./ ১৯১০ খ্রি.- ১৩৯৮ হি./ ১৯৭৭ খ্রি.), প্রিন্সিপ্যাল মওলানা শাহ মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (মৃ. ১৪০০ হি./ ১৯৭৯ খ্রি.), মওলানা মতিউর রহমান নিজামি (১৩৪০ হি./ ১৯২১ খ্রি.-১৪০৭ হি./ ১৯৮৬ খ্রি.) ও মওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল আরকানি (১৩১৬ হি./ ১৮৯৮ খ্রি.- ১৪০১ হি./ ১৯৮০ খ্রি.) প্রমুখ খ্যাতিমান মুহাদ্দিসগণ উল্লেখযোগ্য।

বাহরুল উলূম উপাধি লাভ :
কামিলে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করার পর তাঁর পীর-মুর্শিদ হযরত মওলানা মীর মুহাম্মদ আখতর (রহ.) এর নিকট দু‘আ নিতে আসলে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে সেদিন বাদে জুমআ মাদারবাড়িস্থ তাঁর বাংলায় (ইবাদতখানা) উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি মুখ করান এবং তাঁর কারুকার্যখচিত টুপিটি স্বহস্তে মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিনের মাথায় পরিয়ে দেন। তাঁর ব্যবহৃত সাদা রুমালখানা দ্বারা মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিয়ে “বাহরুল উলূম” (বিদ্যাসাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে উক্ত উপাধিটি তাঁর উভয় পীর-মুর্শিদের জীবদ্দশায় বেশি প্রসিদ্ধি লাভ না করলেও তাঁদের ইন্তিকালের পর তা ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তবে প্রফেসর ড. আহসান সাইয়েদ তাঁর “বাহরুল উলুম শাহসুফি হযরত মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.)” প্রবন্ধে বলেন, “আরবি ভাষায় তাঁর পা-িত্য সর্বজন প্রশংসিত। তিনি এমন সহজ সাবলিলভাবে অনর্গল আরবিতে কথা বলেন এবং লিখেন যা দেখলে মনে হয় আরবি যেন তাঁর মাতৃভাষা। একই সাথে উর্দু ও ফারসি ভাষায়ও তিনি সমান পারদর্শী। তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) এ সকল বিষয়ে তাঁর রয়েছে গভীর জ্ঞান। তাঁর জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ তাঁকে ‘বাহরুল ‘উলূম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।”

শাদি মুবারক :
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি সাতকানিয়া থানার দক্ষিণ রামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত আলিম ও হাকিম মওলানা শফিক আহমদ সাহেবের তনয়া বর্তমান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি.সি. প্রফেসর ড. আহসান সাইয়েদ (আহসান উল্লাহ) (জন্ম ১৩৮৩ হি./ ১৯৬৩ খ্রি.) এর বড় বোন মোছাম্মৎ তাহেরা বেগমের সাথে শুভ পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

বায়‘আত গ্রহণ :
মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ছাত্রজীবন থেকে বাহ্যিক জ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কেননা তিনি মনে করেন, ইসলামি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনের যাবতীয় পাশবিকতা দমন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। তা না করতে পারলে সকল পরিশ্রমই নিষ্ফল। তাঁর মনে এই আধ্যাত্মিক শূন্যতা দূরীকরণার্থে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র পঞ্জুম (দশম) শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ছুটে যান কুমিরাঘোনা ইছালে সওয়াব মাহফিলে। মসজিদে বায়তুশ শরফে মাগরিবের নামায আদায় করে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তিনি বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা শাহসূফি মওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রহ.) এর হাতে বায়‘আত হন।  ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বীয় পীর-মুর্শিদ ইন্তিকাল করায় তাঁরই সুযোগ্য খলিফা শাহ মওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করলে, তিনি তাঁর হাতে পুনরায় বায়‘আত নবায়ন করেন এবং তাঁরই তত্ত্বাবধানে থেকে দরবারের সার্বিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে তাঁকে সর্বোত সহযোগিতা করেন।

কর্মজীবন :
প্রবাদ আছে যে, গড়ৎহরহম ংযড়ংি ঃযব ফধু অর্থাৎ ‘সকাল বেলার সূর্যই বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে।’ তেমনি মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন শৈশব ও যৌবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি ভবিষ্যত কর্মজীবনে মহত্তর এক শীর্ষস্থানের অধিকারী হবেন। ছাত্রজীবনে তাঁর মধ্যে বিশ্বস্ততা, সাধুতা, সময়ানুবর্তিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধৈর্যশীলতা, সত্যানুরাগিতা প্রভৃতি মহৎ গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বস্তুত তাঁর এই মেধা, যোগ্যতা ও দৃঢ়তাই তাঁকে মহত্ত্বের উচ্চ শিখরে পৌঁছতে সাহায্য করে। কামিল পাস করার পর তাঁর অন্যান্য বন্ধুবর্গের (ড. শব্বির আহমদ)-এর ন্যায় স্কুল-কলেজে পড়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর আধ্যাত্মিক ওস্তাদ তথা শ্রদ্ধেয় পীর-মুর্শিদের নির্দেশে এবং শ্রদ্ধাভাজন ওস্তাদ মরহুম হেড মওলানা জনাব মোজাফফর আহমদ (১৩২২ হি./ ১৯০৪ খ্রি.- ১৩৯১ হি./ ১৯৭১ খ্রি.) সাহেবের আন্তরিক পরামর্শে তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সাতকানিয়া থানার রসুলাবাদ সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা, জ্ঞানের গভীরতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বিবেচনা করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদায়ন দেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বৎসর অত্যন্ত যোগ্যতা দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে মাদরাসার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তিনি রসুলাবাদ মাদরাসার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন এবং বায়তুশ শরফ দরবারের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে পীর-মুর্শিদের সার্বক্ষণিক সাহচর্য গ্রহণ করে দীর্ঘ সময়কাল আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন করেন। অতঃপর ১ জানুয়ারি, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবৈতনিকভাবে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১ জুন, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় শিক্ষকবৃন্দের অকৃত্রিম সহযোগিতায় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে “বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদরাসা” শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগে “শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান” হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মরহুম পীর শাহসূফি হযরত মওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হতে অবসর গ্রহণ করে রেকটর পদে উন্নীত হলে, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদ তাঁর প্রশাসনিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করে তাঁকে অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি দান করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ৩১ ডিসেম্বর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর নেয়ার কথা থাকলেও সরকার বিশেষ বিবেচনায় চাকুরির মেয়াদ আরও দুই বৎসর বৃদ্ধি করে দেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেও অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবী ওস্তাদ হিসেবে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার ছাত্রদেরকে বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফসহ অন্যান্য বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের (গভর্নিং বডির) সম্মানিত সভাপতি ও সহ-সভাপতি হিসেবে সার্বিক উন্নয়নেও বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছেন। গবেষক নিজেও এ মহান ব্যক্তিত্ব থেকে বুখারি শরিফ অধ্যয়ন করে ধন্য হন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ১৩ জানুয়ারি, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর শরি‘আহ সুপারভাইজরী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এছাড়াও তিনি আরো বহু দ্বীনি, সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ :
২৫ মার্চ, বুধবার ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মুর্শিদ শাহসূফি মওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করলে, প্রয়াতঃ পীর-মুর্শিদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে এপ্রিল ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ-এর সভাপতি এবং বায়তুশ শরফের পীর হিসেবে খিলাফতের দায়িত্বভার তাঁর স্কন্ধে অর্পিত হয়। তাঁর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মাসিক মদীনার সম্পাদক হযরত মওলানা মুহিউদ্দিন খান এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, “মওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেব একজন বিজ্ঞ আলিম, সূফি ও স্বভাব কবি। তীক্ষè মেধা, অপরিমেয় সাধনা ও যমানার হাদি শাহসূফি হযরত মওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.)-এর যোগ্য উত্তরাধিকারী রূপে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন বলে সকলে আশাবাদী।”

শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানে ভূষিত :
জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ১৯৯৮ উপলক্ষে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান’ (অধ্যক্ষ) এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তিনি জাতীয়ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান’ (অধ্যক্ষ) নির্বাচিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা (জন্ম ১৩৬৭ হি./ ১৯৪৭ খ্রি.) থেকে ‘স্বর্ণ পদক, নগদ অর্থ ও সনদপত্র’ লাভ করেন। সাথে সাথে তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় ও নিবিড় তত্ত্বাবধানে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা ২য় বারের মত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয়ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ হওয়ার গৌরবময় স্বীকৃতি লাভ করে এবং পুরস্কৃত হয়।

শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কর্মকা- :
তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে ‘বায়তুশ শরফ আন্জুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ’ একটি ধর্মীয়, সামাজিক ও তমদ্দুনিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও তড়িৎ কর্মদক্ষতার ফলে বায়তুশ শরফের বহুমুখী কার্যক্রম সুবিস্তৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হল- (১) বায়তুশ শরফ মসজিদ- ১০০টি, (২) মাদ্রাসা- ১৫টি, (৩) এতিমাখানা- ০৭টি, (৪) হেফজখানা- ১২টি (৫) হাসপাতাল- ০৩টি (৬) সুদৃশ্য মজবুত তোরণ (বাবে মীর আখতর) -০১টি। এছাড়া আরো বহু মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা নির্মাণাধীন রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বায়তুশ শরফের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় দু’শরও অধিক উন্নয়নমূলক ও সংস্কারধর্মী কর্মকা- তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয়েছে।

দক্ষ মানুষ গড়ার কারিগর :
কর্মীর দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। তিনি নিজেই একজন দক্ষ প্রশাসক ও প্রশিক্ষক ছিলেন। সে হিসেবে তরিকতপন্থী আলেমে দ্বীন, মুবাল্লিগ ও তরিকতের অনুসারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ কল্পে বায়তুশ শরফের বর্তমান পীর সাহেব (ম.জি.আ.) কুরআন-হাদিস, শরি‘আত- তরিকত, হাকিকত-মা‘রিফত এর অপূর্ব মিলন ঘটিয়ে মরহুম পীর সাহেব (রহ.)-এর সে তা‘লিমি সপ্তাহের ধারাবাহিকতার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফ, আন্জুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ২৪ হতে ২৯ জুলাই ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর একক পরিচালনায় সপ্তাহব্যাপী এক ফলপ্রসূ তা‘লিমি সপ্তাহের  আয়োজন করা হয়। সারা দেশ থেকে নির্বাচিত প্রায় ৫০০ জন তরিকতপন্থী ‘আলিম-‘উলামা, ছাত্র-শিক্ষক ও বায়তুশ শরফের ভক্ত-অনুরক্ত এতে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিদিন ৪টি অধিবেশনে তা‘লিম-তরবিয়ত অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রশিক্ষক ছিলেন পীর ছাহেব (ম.জি.আ)। জিকির ও সালাতুত তাহাজ্জুদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফের খতিব আলহাজ্ব মওলানা নুরুল ইসলাম (জ. ১৩৭৩ হি./ ১৯৫৩ খ্রি.)। এটি ছিল বায়তুশ শরফের ৫ম তালিমি সপ্তাহ। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে সংক্ষিপ্তভাবে আরও দু’বার তালিমি সপ্তাহের ব্যবস্থা করেন।

জ্ঞানীগুণীদের পৃষ্ঠপোষক :
ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশেও তাঁর অবদান অনন্য। পীর-মুর্শিদের পূর্বধারা অব্যাহত রেখে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরের ধনিয়ালাপাড়া বায়তুশ শরফ প্রাঙ্গণে প্রতি বৎসর চার দিনব্যাপী ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে ‘তমদ্দুনিক প্রতিযোগিতা’ নামে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ ‘ইসলামি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা’। যাতে দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতি বৎসর সহ¯্রাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে থাকে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবৎসর ৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেওয়া হয় গুণীজন সংবর্ধনা। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৯০ জন দেশের সেরা গুণী ব্যক্তিত্বকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

কাব্যিক প্রতিভা :
তিনি একজন স্বভাবজাত কবি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠানে আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় উপস্থিত স্বরচিত কবিতা পাঠ করে তিনি হয়েছেন প্রশংসিত ও নন্দিত। তাঁর বহু উর্দু, ফারসি ও আরবি কবিতা বহুল প্রচারিত মাসিক দ্বীন দুনিয়া, আল-আছরার, আলো, আন্জুমনসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়ে আসছে। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সম্প্রতি ‘গুলহায়ে আকীদত’ নামে উর্দু ভাষায় একটি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বরচিত প্রায় ৫০০ দুলর্ভ কবিতা স্থান পেয়েছে।

ওয়াজ-নসিহত :
ওয়াজ-নসিহতে তিনি এক কিংবদন্তী। প্রথিতযশা আলিমে দ্বীন, মুহাদ্দিস ও সুবক্তা জ্ঞান-গর্ভ ওয়ায়েজ হিসেবেও দেশ-বিদেশে রয়েছে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি। অত্যন্ত সহজ সরলভাবে কুরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস ও মনীষীদের আরবি, উর্দু ও ফারসি বয়েত ও শ্লোকের মাধ্যমে যুক্তি সহকারে হৃদয়গ্রাহীভাবে মানুষের কাছে তিনি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। তাঁর ওয়াজের স্টাইল একান্তই তাঁর নিজস্ব। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি খুবই প্রখর। তাঁর সুমধুর বচন আর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা উপস্থিত সবাই নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকেন, দেখলে মনে হয় যেন তাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে। তাঁর ওয়াজ শুনে হাজারো মানুষ হিদায়তের পথে এসে নিজেদের জীবনকে ধন্য করছে। আল্লামা ইকবাল (রহ.)-এর এ কবিতাটি তিনি প্রায় সময় সুমধুর সুরে পড়েন- “হে আল্লাহ্! মুসলমানদের অন্তরে সেই জীবন্ত আশা সৃষ্টি করে দিন, যা প্রাণকে আন্দোলিত করে এবং অন্তরকে উষ্ণতা দান করে।”

আর্তমানবতার সেবায় :
শাহ্সূফি মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) ছিলেন কোমল হৃদয়ের লোক। মানুষের সুখে সুখী হওয়া এবং দুঃখে দুঃখী হওয়া তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দুঃখী মানুষের করুণ অবস্থা দেখলে তাঁর হৃদয়-মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। এজন্য তিনি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুশ শরফের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরায় বন্যা দুর্গতদের মাঝে ব্যাপক ত্রাণ বিতরণে তৎপরতা চালান। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলাসহ মধ্যাঞ্চলের ৪১টি জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রলয়ংকরী বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লে তিনি বায়তুশ শরফের ভক্ত-অনুরক্ত এবং সর্বস্তরের মুমিন মুসলমানদের নিকট থেকে লক্ষাধিক টাকার ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকায় গমন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ঢাকার সাভারের অদূরে ধামরাই উপজেলা এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলাধীন কাঁচপুর এলাকায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের হাতে হাতে তিনি স্বহস্তে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেন।  এছাড়াও তিনি দেশের এ বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি লাভের জন্য বায়তুশ শরফ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে খতমে বুখারি শরিফ, খতমে কুরআন শরিফ ও খতমে খাজেগানসহ বিভিন্ন দুআর ব্যবস্থা করেন। বর্তমানেও তিনি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী সহায়তা করেন।

দানশীলতা :
আমাদের দেশের সাধারণ নিয়ম হলো পীর-মুর্শিদরা হাদিয়া গ্রহণ করেন সঞ্চয়ের জন্য, আর বায়তুশ শরফের বর্তমান পীর সাহেব (রহ.) তাঁর পূর্ববর্তী পীর মুর্শিদদ্বয়ের অনুসরণে সঞ্চয় করেন দান করার জন্য। অথচ সংকীর্ণতার নাগপাশে আবদ্ধ এ দেশের অধিকাংশ আলিম সমাজ শুধুমাত্র “দান গ্রহণ কর হে, না করিবে দান” এ নীতির জন্য সর্বকালে সমালোচিত। তাছাড়া জনগণের মুখে প্রবাদ আছে “মোল্লারা শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না” কিংবা “পীর সাহেবরা মুরীদি ব্যবসা করে কোটি টাকার মালিক।” কিন্তু এখানেই তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র পরিলক্ষিত হয়। তিনি এ সমস্ত প্রবাদের উর্ধ্বে উঠে দানশীলতার এক কালজয়ী স্বাক্ষর রেখেছেন। মুরিদরা তাঁকে হাজার টাকা হাদিয়া দেন কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষ, গরিব-দুঃখী, ছাত্র ও অভাবীদেরকে প্রকাশ্যে ও গোপনে লক্ষ টাকা দান করেন। তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ হাদিস প্রায়শঃ বলে থাকেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা সাত শ্রেণির মানুষকে তাঁর আরশের নিচে ছায়া দান করবেন, যে দিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ হল যারা নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় দান করেন।

স্বভাব-চরিত্র ও চারিত্রিক মাধুর্য :
শাহ্সূফি মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) অত্যন্ত বিনয়ী, মহানুভব, বলিষ্ঠ চরিত্র ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক মহান আধ্যাত্মিক সাধক। তাঁর মধ্যে আল্লাহ্ প্রদত্ত বহুবিধ প্রতিভার অন্যতম একটা দিক হল সঠিক নেতৃত্বদানের যোগ্যতা। তিনি অনেক বড় বড় মাহফিল একক নেতৃত্বেই সম্পন্ন করে থাকেন। আল্লামা ইকবালের ভাষায়, “কাফেলার নেতা হবেন উঁচু ও উদার দৃষ্টির অধিকারী। তাঁর কথামালা হবে হৃদয়গ্রাহী, তাঁর অন্তর হবে দরদ ও ব্যথায় ভরা। এগুলো হচ্ছে সঠিক আমিরে কাফেলার সফরের পাথেয়।”

তাঁর এখলাস, ক্ষমা প্রদর্শন, মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা, সত্যবাদিতা, বদান্যতা, আতিথেয়তা, নন্দনীয়, আকর্ষণীয় এবং আদর্শ স্থানীয়। তিনি অত্যন্ত কোমল ও বিনয়ী চরিত্রের অধিকারী। বিনয় তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। তাঁর এ ¯েœহময়ী আচরণ ও অনুপম ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে মধুমক্ষিকার ন্যায় মানুষ তাঁর প্রতি ছুটে আসে। তিনি হলেন অনুপম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী। জাতি ধর্মবর্ণনির্বিশেষে তিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি ব্যথিতের বেদনা উপলব্ধি করতে পারেন এবং তা দূর করার চেষ্টা করেন। বলাই বাহুল্য, এটাই বিলায়তের প্রকৃত লক্ষণ। কবির ভাষায়, “নেয় নি কেড়ে হৃদয়-মন একটি বিষয়, কেড়ে নিয়েছে মোর মন দু’ চার বিষয়, জান কি তুমি সে সব বিষয় আমার? বলায়, চলায়, কাজে ও আচরণে গাম্ভীর্যের বলয়।”
ইসলামি ইতিহাসের বিশিষ্ট গবেষক ও সুপ-িত প্রফেসর ড. শব্বির আহমদ তাঁর গুণাবলীর অকপট স্বীকৃতি দিয়ে বলেন,

“তাঁর সুমহান জীবনচরিত, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব, নিঃস্বার্থপরায়ণতা, নিষ্কলুষ যিন্দেগি ও উত্তম চরিত্র মাধুরী। মানবীয় এ গুণগুলো তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে নৈতিক ও মানবিক উচ্চাসনের সর্বোচ্চ শিখরে।”

গ্রন্থ রচনা :
শাহ্সূফি মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) যেমন একজন আধ্যাত্মিক সাধক, সফল ও সুযোগ্য শিক্ষক, কামিল পীর, তেমনি একজন প্রাজ্ঞ লেখক। ইসলামের খিদমতের সকল ক্ষেত্রেই তিনিই সফলতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। ওয়াজ-নসিহত, তা‘লিম-তরবিয়াত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি গ্রন্থ রচনায়ও তিনি রাখছেন অনন্য ভূমিকা। তাঁর লিখিত ও অনুদিত গ্রন্থগুলো-
১. জান্নাতী ও জাহান্নামী যারা (অনুবাদ গ্রন্থ)
২. বেশারাতুল ইখওয়ান ফি খাওয়াচ্ছিল কুর’আন
৩. দো‘আয়ে মুসতাজাবুদ দাওয়াত
৪. কাশেফে হাজাত
৫. কিতাব ও সুন্নাহ্র আলোকে তরিকতের মূলনীতি
৬. গুলহায়ে আকীদত
৭. নির্বাচিত ভাষণ।
৮. হেদায়েতের আলো (ওয়াজ সংকলন)।

তাছাড়া শিশু-কিশোরদের মাঝে ইসলামি তাহজিব তমদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার জাগ্রত করার মানসে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে “মাসিক শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া” নামে স্বতন্ত্র মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে।

হজ্ব পালন ও বিভিন্ন দেশ সফর :
তিনি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত ৫২ বারের অধিক পবিত্র হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেন। ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ইরাক, সুইজারল্যান্ড, জর্ডান, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বহু দেশ সফর করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি এক পুত্র ও ছয় কন্যার জনক। পুত্র-কন্যারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা হলেন, মোছাম্মৎ হান্নানা বেগম, মোত্মাইন্নতুল জন্নাত কাওছার, মাওলানা মোহাম্মদ ছলাহ উদ্দিন বেলাল, মোছাম্মৎ তছনীমা বেগম, উম্মে রুম্মান শমা, উম্মে হানি রৌনক, মোর্কারমাতুল জন্নাত আমন্।

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ এই মহৎ হৃদয়বান, আলেমে দ্বীন ও সমাজ হিতৈষীকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে দাখিল করুন। আমীন।

-মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ

No comments:

Post a Comment