26 April 2020

আল্লাহ কেন"সাওম"বা রোযা ফরজ করলেন?


রোযা এটি ফারর্সী শব্দ। আরবীতে বলা হয় "সাওম"।এর আভিধানিক অর্থ হল বিরত থাকা, উপবাস থাকা, আত্মসংযম করা, কঠোর সাধনা করা, অবিরাম চেষ্টা করা ইত্যাদি। ইসলামের দৃষ্টিতে সাওমের নিয়তে
 সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাই হল রোযা।

রোযা ফরজ হওয়ার দলীল-০১:
***************************
শরীয়তে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে ইহা একটি অপরিহার্য ইবাদত।রোযা ফরয করা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
يا ايها الذين امنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون.
অর্থ:হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হলো, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয ছিলো।যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।   (বাকারা১৮৩)                                      শুধু তাই নয় সুরা বাকারার ১৮৩নংথেকে১৮৭নংআয়াত পর্যন্ত বিস্তারিত রোযার হুকুম আহকাম রোযা রাখার পদ্ধতি যথাযথভাবে আল্লাহ তাআলা বলেন দিয়েছেন।যা অন্যকোন ইবাদতের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে একজায়গায় এভাবে বলা হয়নি।

নির্দেশনা০১:রোযা শুধু আমাদের উপর ফরয করা হয়েছে এমন নয়,বরং আলোচ্য আয়াত দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায়, আমাদের পূর্ববর্তী নবীগণ এবং তাদের উম্মতের উপরও রোযা ফরয ছিলো।এখানে আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীয়াকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন যে,তোমরা রোযা রাখতে ভয় করো না।কেননা আদম(আ:) থেকে ঈসা(আ:) পর্যন্ত সমস্ত নবীদের উম্মতের উপরই ইহা ফরয ছিলো। সুতরাং তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই(হাকেম-মুসতাদেরেক-দারেমী)

নির্দেশনা:২: আমাদের উপর রোযা কেন ফরয করা হয়েছে-আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে তা স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছেلعلكم تتقونঅর্থাৎ রোযার মাধ্যমে যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।তাহলে আমাদের উপর রোযা ফরয করার মূল উদ্দেশ্যই হল তাকওয়া হাসিল করা তথা "মূত্তাকী" বানানো।আর তাকওয়া অর্থ হলো: খোদাভীতি, অন্তরে আল্লাহর ভয় ইত্যাদি। অর্থাৎ কোন কাজ করার সময় মনে এই খেয়াল রাখা যে, পৃথিবীর কেউ আমাকে না দেখলেও আমার আল্লাহ আমাকে দেখেছেন। অন্তরে এই খেয়াল জাগ্রত হওয়ার নাম-ই হচ্ছে"তাকওয়া"। তাহলে রোযা ফরয করার উদ্দেশ্যে হল জান্নাত উপযোগী করে আমাদেরকে তৈরি করা১১ মাসের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ার প্যাকেজ ঘোষণা করা।
রোযা ফরয হওয়ার দলীল-০২:

আল্লাহ পাকের ঘোষণা-
فمن شهد منكم الشهر فليصمه ومن كان مريضا أو على سفر فعدة من أيام اخر يريد الله بكم اليسر ولا يريد بكم العسر ولتكملوا العدة ولتكبروا الله على ما هداكم ولعلكم تشكرون.
অর্থ:অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি মাসটি পাবে,সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না।আর তাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়ত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।   (বাকারা১৮৫)

নির্দেশনা:: "তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে'আলোচ্য এই আয়াত কয়েকটি উদ্দেশ্য হতে পারে:
০১।কোন নাবালক এ মাসে বালেগ হলে এ মাস থেকেই           
রোযা রাখবে।
০২।কোন কাফির এ মাসে মুসলমান হলে এ মাস থেকেই রোযা রাখবে।
০৩। কোন অসুস্থ লোক এ মাসে সুস্থ হলে এ মাস থেকেই রোযা রাখবে।
০৪।কোন মুসাফির এ মাসে মুকিম হলে এ মাস থেকেই রোযা রাখবে।
০৫।কোন হায়েজ- নেফাসগ্রস্তা মহিলা এ মাসে পাক হলে এ মাস থেকেই রোযা রাখবে।    উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত লোকদের কেউ যদি পুরো রমযান মাস পায়, তাহলে পুরো রমযান মাস রোযা রাখবে।আর যদি আংশিক পায়,তবে যতদিন পাবে ততদিনই রোযা রাখবে। (মাআরিফ- ৯৪)

#আসুন জানা যাক কি কি কারনে রোযা নষ্ট হয়ে যায় বা ভেঙ্গে যায়?কখন কাযা আর কাফফারা দিতে হয়?

নিম্নোক্ত দু'টি কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হয়।আর রোযার কাফফারা হল একাধারে ৩০+৩০=৬০ টি রোযা রাখা। কাফফারা আদায় করতে গিয়ে যদি মাঝখানে একটি রোযাও ছুটে যায় তাহলে পুনরায় নতুনভাবে শুরু করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন: فمن لم يجد فصيام شهرين متتابعين من قبل أن يتماسا فمن لم يستطع فإطعام ستًين مسكينا ذالك لتؤمنوا بالله ورسوله وتلك حدود الله وللكافرين 
عذاب اليم
অর্থ: কিন্তু যে তা পাবে না,সে লাগাতার দ'মাস সিয়াম পালন করবে,একে অপরকে স্পর্শ করার পুর্বে।আর যে,(এরূপ করার) সামর্থ্য রাখে না সে ষাটজন মিসকিনকে খাবার খাওয়াবে। এ বিধান এ জন্য যে, তোমরা যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন।আর এগুলো আল্লাহর ( নির্ধারিত)সীমা এবং কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। (মুজাদালা০৪)

কেন কাযা ও কাফফারা একসাথে ওয়াজিব হয়?

১ম কারণ::রোযা রাখার পর দিনের বেলায়                                                                   ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে।
২য় কারণ::রোযা রাখার পর দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে স্বামী-স্ত্রী মিলন করলে। উপরোক্ত দুই কারণে কাযা- কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হবে।

#কাফফারা আদায়ের সময় পুনরায় রোযা এসে গেলে? কি করবেন?

রোযার কাফফারা আদায়ের সময় ঐ ৬০ দিনের মধ্যে যদি পুনরায় রমযান মাস এসে যায় অথবা মহিলাদের নেফাস(গর্ভ খালাস) হয়ে যায় তাহলে কাফফারা আদায় হবে না বরং রমযান শেষে বা নেফাস খতম হওয়ার পর পুনরায় কাফফারা আদায় করতে হবে।তবে হায়েজের কারণে বিরতি হলে কোন অসুবিধা নেই।

#বিরতিহীনভাবে৬০টি রোযা রাখতে সক্ষম না হলে? কি করবেন?

বিরতিহীনভাবে ৬০ টি রোযা রাখতে সক্ষম না হলে ৬০ জন মিসকিনকে তৃপ্তির সাথে দুই বেলা খাওয়াতে হবে অথবা একজনকে দুই বেলা ৬০ দিন খাওয়াতে হবে।অথবা ৬০ জন লোক প্রত্যেককে একটি করে সদকায়ে ফিতর পরিমাণ মাল বা নগদ অর্থ দিতে হবে।(ফাতওয়ায়ে আলমগীরী ১:২১৯পৃ ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম ৬:৪২৯পৃ, ফাতহুল কাদীর ২:২৫৪পৃ,হিদায়া১:২১৯পৃ.)
#হস্তমৈথুন দ্বারা বীর্যপাত ঘটালে করণীয় কী?
*************************************
হস্তমৈথুন বা যৌনাঙ্গ নাড়াচাড়াতে কিংবা স্ত্রীকে স্পর্শ করার দ্বারা বীর্যপাত ঘটালে রোযা ভেঙ্গে যাবে।তবে এ কারণে কাফফারা ওয়াজিব হবে না,বরং শুধু একটি রোযা কাযা করে দিলেই আদায় হয়ে যাবে।(ফাতওয়ায়ে আলমগীরী ১:২০২পৃ, ফাতওয়ায়ে রাহীমীয়া৭:২৯৩পৃ,)

কি কি কারণে রোযার কাযা আদায় করতে হবে?
**********"*******************************?
নিম্নোক্ত কারণমমুহে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং পরবর্তীতে কাযা করা ওয়াজিব হবে।
০১। ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরিয়া বমি করা
০২। বিড়ি সিগারেট বা যেকোনো ধুমপান করা কিংবা ইনহিলার ব্যবহার করা।
০৩। অখাদ্য খাওয়া:যেমন- লোহা,পাথর,কয়লা, কাগজ,মাটি ইত্যাদি।
০৪। কোন নারীকে স্পর্শ করার কারণে বীর্যপাত হওয়া।
০৫। কুলি করার সময় অনিচ্ছাবশত: পানি পান করা।
০৬। নাকে বা কানে ঔষধ দেয়া।
০৭। ভুলে পানাহার করার পর পুনরায় ইচ্ছা করে পানাহার করা।
০৮। রাত আছে মনে করে সুবহে সাদিকের পর পানাহার করা।
০৯। সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে সূর্যাস্তের পুর্বে পানাহার করা।
১০। দাঁদ দিয়ে বেশী পরিমাণ রক্ত বের হওয়ার পর তা গিলে ফেলা।
১১। দাঁতে ছোলা বা বুট পরিমাণ আটকে থাকা খাদ্য গিলে ফেলা।
১২। হস্তমৈথুন করার কারণে বীর্যপাত হওয়া।
১৩। পেশাব পায়খানার রাস্তা দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করানো
১৪। মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সুবহে সাদিকের পর ঘুম থেকে জাগা।
১৫। নস্যি গ্রহণ করা বা কানে তেল ঢালা।
১৬। রোযার নিয়ত না করা। উল্লেখিত কারনে রোযার কারা আদায় করতে হবে।
(তথ্যসূত্র:ফাতওয়ায়ে আলমগীরী,ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম, মাহমুদিয়া,রাহমীয়া,শামী,জামেয়া, ইমদাদুল ফাতওয়া, আযিযুল ফাতওয়া,রাদ্দুল মুখতার, ইমদাদুল আহকাম, ইত্যাদি।)
রোযার মাসে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে করনীয় কি?
************************আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা।
آياما معدودات فمن كان منكم مريضا أو على سفر فعدة من أيام اخر وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين فمن تطوع خيرا فهو خيرله وأن تصوموا خير لكم إن كنتم تعلمون.
অর্থ: নির্দিষ্ট কয়েক দিন(রোযা ফরয)।তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে,কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য"ফিদয়া"-একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা।অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে,তা তার জন্য কল্যাণকর হবে।আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর,যদি তোমরা জান।  (বাকারা ১৮৪)

মাসয়ালা:: আলোচ্য আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে,যে ব্যক্তি অসুস্থ সে রোযা রাখবে না।আর যাদের অতিরিক্ত ডায়াবেটিস তারাও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া রোযা রাখবে না। যে সকল অসুস্থ ব্যক্তি রোযা রাখতে পারবে না বা আদো রাখতে পারার সম্ভাবনা কম তারা "ফিদয়া" দিবে।এই আয়াত থেকে আরো বুঝা যায় যে, সফর অবস্থায় রোযা রাখা ওয়াজিব নয়। এমনকি সারাজীবন সফরে থাকলেও তার উপর রোযা ওয়াজিব হবে না।বরং এক্ষেত্রে "মাযুর" বলে গণ্য হবে।আর এজন্য তার কোন গুনাহ ও হবেনা।তবে কেউ যদি সফর অবস্থায় রোযা রাখে তাহলে সহীহ হবে।(আযিযুল ফাতওয়া-১:৪৭৭পৃ, ইমদাদুল ফাতওয়া ২:১৪৪পৃ,) সফরে রোযার মাসায়ালা রসুল (স:) হাদীস দ্বারা প্রমাণিত
عن عاءشة قالت إن حمزة بن عمرون الاسلمى قال للنبى (صلعم) اصوم فى السفر؟وكان كثيرا الصيام فقال إن شءت فصم وان شٕءت فافطر.
অর্থ: হযরত আয়েশা রা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:হামযা বিন আমের আসলামী বেশী বেশী রোযা রাখত। একদা সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল: হুজুর আমি কি সফর অবস্থায় রোযা রাখতে পারি? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:যদি চাও রাখতে পার,আর যদি চাও নাও রাখতে পার। (বুখারী)    আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমল করার তাওফীক দিন ****আমীন****।

ধারাবাহিক আলোচনা চলবে ইনশাআল্লাহ।(সকলে শেয়ার করুন একে অপরকে জানিয়ে দিন অনেকের উপকারে আসবে)

লেখক-
মাওলানা নুরুজ্জামান মঞ্জু, 
অধ্যাপক, রাজাখালী বিইউআই ফাযিল মাদ্রাসা।
সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পেকুয়া উপজেলা।

No comments:

Post a Comment