12 July 2019

বন্যার সময় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকতে যা যা করণীয়

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগগপ্রবণ দেশ। উত্তরের হিমালয় পর্বতমালা ও দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশকে জীবনদায়ী মৌসুমী জলবায়ু প্রদান করলেও এর সাথে অনুদান হিসেবে বাড়িয়ে দিয়েছে বিধ্বংসী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি ও হিমালয় পর্বতে বরফগলা পানি সমসাময়িক সময়ে বন্যার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার পানি হিমালয় পর্বতমালার ঢাল বেয়ে প্লাবিত করছে পাদদেশীয় সমভূমিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা।
আকস্মিক বন্যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ক্রমাগত বন্যা এদেশর মানুষের জীবন ও জীবিকা উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে।কৃষিকাজ ও কৃষি অথনীতি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ধ্বংসাত্বক প্রভাব রয়েছে আকস্মিক বন্যার। দুর্যোগের সময়ে সৃষ্টি হয় খাদ্যসংকট, বিশুদ্ধ খাবার পানি অভাব; তাছাড়া ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ।তদুপরি, জনসংখ্যার চাপ, হতদরিদ্রতা, অতিনির্ভর কৃষি অথনৈতিক ব্যবস্থা, বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। 
দুর্যোগের প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড দুর্যোগের বিপদপন্নতা প্রশমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের বন্যা দুর্যোগের প্রস্তুতিমূলক কমকান্ডকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়।

প্রাক-বন্যা প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড
ক. বসতবাড়ির ভিটা, নলকূপ, ল্যাট্রিন উঁচু করতে হবে। এক্ষেত্রে অতীতের বন্যার পানির উচ্চতার মাত্রা স্মরণ রাখতে হবে।
খ. কৃষি শস্য ও বীজ সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ স্থানে মাচা তেরি করতে হবে।
গ. গৃহপালিত পশু নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ. শুকনো খাবার বিশেষত মুড়ি, চিড়া, গুড়, চিনি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে।
ঙ. বিশুদ্ধ খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য চৌবাচ্চার ব্যবস্থা করতে হবে।
চ. সহজে বহনযোগ্য চুলা ও রান্না করার জন্য শুকনো জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে।
ছ. পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ (ডায়রিয়া ও উদারাময়) এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংরক্ষণ করতে হবে।

বন্যাকালীন প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড
ক. বৃদ্ধ, শিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও গর্ভবতী মহিলাদের উপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
খ. প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিশেষ করে টাকা-পয়সা, জমির দলিল পত্র, শিক্ষাগত সনদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে।
গ. পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার হাত অন্যের বিপদে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
ঘ. কোনমতেই বন্যার দূষিত পানি পান করা যাবে না।পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করে পানি পান করা যাবে।
ঙ. বন্যার পানিতে গোসল করা, জামা-কাপড় ধোয়া যাবে না।

বন্যা পরবর্তী প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড
ক. বন্যয় ক্ষতিগ্রস্থ ঘরবাড়ি মেরামত করতে হবে।
খ. বাড়ির আঙ্গিনা থেকে ময়লা আরজনা পরিষ্কার করতে হবে।
গ. পয়নিষ্কাশনপ্রণালী মেরামত করতে হবে।
ঘ. কৃষিকাজকে ত্বরান্বিত করতে ঋণগ্রহণ করা যেতে পারে।
ঙ. জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কাজের অনুসন্ধান করতে হবে।
তারপরেও, বানভাসি মানুষের দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমিয়ে দুর্যোগ পরবতী ব্যবস্থা হিসেবে যত দ্রুত সম্ভব আক্রান্ত মানুষদের পুনরুদ্ধার করে প্রয়োজনীয় ত্রাণ বিতরণ করা, সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠিান মেরামত করা, বিভিন্ন অবকাঠামো পুনরায় নির্মাণ করা, চিকিৎসা স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্থ জনগনের পুনবার্সনের ব্যবস্থা করা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি এগিয়ে আসতে হবে। প্রস্তুতি, সাড়াদান, পুনরুদ্ধার এবং প্রশমন; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সব পর্যায়ে সকল অংশীজনদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
১. বন্যা দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ন্যায্যতা অনুযায়ী ত্রাণসামগী বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য পুলিশ প্রশাসন, আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষাবাহিনী, সামরিক বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুত থাকতে হবে দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। বৃদ্ধ ও মহিলাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রাণসামগী বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
২. দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকে বাঁচাতে বিনামূল্যে কৃষিবীজ বিতরণ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করার জন্য সরকারের পাশাপশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩. বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনকে ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারী ব্যাংকের পাশাপশি বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করার জন্য ।
৪. বানভাসি মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের ডাক্তার, নিবন্ধিত ডাক্তার, ইন্টার্ন ডাক্তার এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।
৫. অপরাধকর্ম ও সহিংসা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় সরকার, উপজেলা প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে।

পেটের পীড়া (ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড), বুকের প্রদাহ, জ্বর, চর্মরোগ, চোখের অসুখ, সর্প দংশন।

বন্যার সময় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকতে যেটি করবেন:

বন্যা আসে, বন্যা যায়। ধকলটা থাকে দীর্ঘ সময়। ধকল যেহেতু আসবেই, তাই আগেভাগে নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা শ্রেয়। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয় গ্রামাঞ্চলে। যার প্রভাব পড়ে শহরসহ সারাদেশেই। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের নানান উপায়ে এই সময়ে সচেতন করে রাখা উচিত।

বন্যায় সৃষ্ট রোগবালাই থেকে সুরক্ষা পেতে:
  1. যেহেতু বন্যায় পানির উত্স সংক্রমিত হয়ে যায় তাই পানি ভালোমতো না ফুটিয়ে পান করা নিরাপদ নয়।
  2. টিউবওয়েলের পানিও ফুটিয়ে পান করতে হবে। পানি ফুটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরুনণ ট্যাবলেট (হ্যালোট্যাব) ব্যবহার করতে হবে।
  3. ডায়রিয়া দেখা দিলেই পরিমাণমতো খাবার স্যালাইন খেতে হবে। যেসব স্বাস্থ্যকরুন্মী বন্যার্তদের সাহায্যে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের কাছে পর্যাপ্ত স্যালাইন থাকতে হবে। যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায় সে ক্ষেত্রে শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে।
  4. বন্যায় নিরাপদ পয়ঃপ্রণালীর অভাব ঘটে। পয়ঃনিষ্কাশন নিরাপদ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময়ে কৃমির ওষুধ খেতে হয়। কেননা নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। যেখানে সেখানে পায়খানা না করে একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে।
  5. খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খাবার যাতে পচে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  6. বন্যায় চর্মরোগ হতে পারে। যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। একই গামছা বা তোয়ালে অনেকজন ব্যবহার করবেন না।
  7. চোখের প্রদাহ হলে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখবেন। কেননা সমস্যাটি ভাইরাসজনিত হলে তা অন্যদের মাঝেও সংক্রমিত হবে। ক্লোরাম ফেনিকল আই ড্রপ হাতের কাছে রাখতে হবে। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকরুন্মী বা চিকিত্সকের পরামর্শক্রমে তা ব্যবহার করতে হবে। চোখে অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  8. বন্যায় মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। ব্যাপক মশা নিধনের ব্যবস্থা না করলে ম্যালেরিয়া হতে পারে।
  9. এক সময় মনে করা হতো বন্যা পাপের ফল। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো বন্যা এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করতে হলে সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। বন্যাকে নিয়তির লিখন হিসেবে চিহ্নিত না করে বন্যায় যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে তার নিরসন করতে কার্পণ্য করা উচিত নয়।

বন্যায় সম্পদ, জানমাল সুরক্ষায় করুনণীয়:
  1. বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে শাক-সবজি, শস্য, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগীসহ নিজেদের পরিবার পরিজন ও আবাসস্থল রক্ষায় চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান গ্রামের মানুষ। এই অবস্থায় মাথায় হাত দিয়ে হতাশায় ডুবে যাবার মানে নেই। এমন পরিস্থিতিতে কী করুনণীয় তার একটা ছোট ধারণা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-
  2. বন্যায় যদি বীজতলা ডুবে যায়, তাহলে নানানভাবে চারা উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখা ভালো। যেমন – কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সেই ভেলার উপর কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে বীজ ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। আর যদি বীজতলায় কোনো চারা আগে থেকেই থাকে তাহলে মাটিসহ তুলে কোনো উঁচুস্থানে রাখতে হবে।
  3. বন্যার পানি বেড়ে যাবার সাথে সাথে ড্রাম, টব, চাড়ি বা অন্য কোনো বড় পাত্রে মাটিসহ গাছের চারা রোপণ করে উঁচুস্থানে রাখতে হবে।
  4. বন্যায় মাছ চাষের বরাদ্দকৃত জায়গার চারপাশে পানি থেকেও কয়েক ফুট উঁচু জাল দিয়ে রাখতে হবে।
  5. গবাদিপশু রক্ষায় আগেভাগেই ক্কুরা, বাদলা, তড়কা ও অন্যান্য রোগের টিকা দিতে হবে। বন্যায় যদি কোনো গবাদিপশু মারা যায়, তাহলে সেই মরা পশু পানিতে ভাসিয়ে না দিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
  6. বন্যার সময় হাঁস –মুরগীর কৃমির প্রকোপ বাড়ে, তাই আগেভাগে এসবের ওষুধ খাওয়াতে হয়। তবে সবচেয়ে উত্তম কাজ, বন্যার সময় হাস-মুরগি বিক্রি করে ফেলা।
  7. গাছের যত্নে গাছের গোড়ায় মাটি দিতে হয়, চারাগাছ হলে খুঁটি দিতে হয়, বন্যার পর রাসায়নিক সার ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হয়।
  8. বন্যার সময় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এ জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ রাখতে হবে। সময়মতো ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সরবরাহ করাও অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া বন্যার পানি চলে যাওয়ার পরও দেখা দেয় ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধি। এ জন্য খাওয়ার স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।







No comments:

Post a Comment