বালাকোট থেকে শাপলাচত্বর
বালাকোট দিবসঃ
১৮৩০ সালের এই দিনে বালাকোটের ময়দানে এক অসম যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (রহ.) ও তাঁর সহযোদ্ধারা। ভারতীয় উপমহাদেশে তৎকালীন মুসলমানদের প্রাণ পুরুষ ছিলেন শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (রহ.)। আজও তিনি অত্যন্ত সম্মানের পাত্র হয়ে আছেন। সেই সাথে ৬ মে স্বাধীনতা প্রিয় মুসলমানদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ
দিন। বালাকোটের শহীদদের প্রেরণায় ভারতে মুসলমানগণ আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক আবাসভূমি লাভে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
সারা উপমহাদেশ থেকে উৎসাহী যুবক ও ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেন। তার নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী মুজাহিদগণ ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রসিদ্ধ নগরী পেশোয়ার দখল করে শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) সেখানেই প্রধান কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন।
সৈয়দ আহমদের বাহিনীর সাথে কয়েকটি যুদ্ধে শিখ ও ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়। সারা ভারতের মুসলমানদের নিকট শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সম্মুখ সমরে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে টিকে উঠা সম্ভব নয় এ ভেবে বৃটিশ ও শিখ নরপতিগণ কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করলো।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সফল সিন্ধু অভিযানের মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশে মুসলমানগণের আনুষ্ঠানিক আগমন ঘটে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগমনের পূর্বে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পারস্য ও মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান, খোরাসান, তাজাকিস্তানসহ আফগানিস্তানে মুসলিম অধিকার বিস্তৃত হয়ে তৌহিদী ঝাণ্ডা চীনের প্রাচীরের দিকে ধাবিত হয়।
মহানবী (সা.)-এর মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই অর্ধ পৃথিবীব্যাপী ইসলাম নামক শান্তি ও সভ্যতার মহা প্লাবন বাঁধভাঙ্গা বন্যার মত বিস্তার লাভ করে। ইসলামের এই দাওয়াতী অভিযান এই উপমহাদেশের দ্বারপ্রান্তে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর আফগান শাসক সুলতান মাহমুদ বারংবার ভারত আক্রমণ করে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করেন।
সুলতান মাহমুদের পর মুহাম্মদ ঘোরী দিল্লীতে মুসলিম সম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা হোক মুহাম্মদ বিন কাসিম থেকে নবাব সিরাজদ্দৌলা পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর মুসলমানগণ এই উপমহাদেশে শাসন কার্য চালিয়েছেন।
পরবর্তীতে মুসলিম শাসক ও সমরবিদগণ নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে বিলাসিতা, ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ সুযোগে ইউরোপের উদীয়মান শক্তি ইংরেজ ও ফরাসীগণ ভারতে তাদের সম্রাজ্যবিস্তারের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে।
উপমহাদেশের বিচ্ছিন্ন মুসলিম শক্তি এই বিদেশি বেনিয়াদের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হবার পরিবর্তে এক মুসলমান অন্য মুসলমান ভাইয়ের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে বিদেশিদের সাহায্য কামনা করতে থাকে। ভারতের অমুসলিম বিশেষ করে রাজপুত, মারাঠা ও শিখগণ এদেশ থেকে মুসলমানদের বিতাড়ণের মোক্ষম সুযোগ বুঝে ইউরোপীয় শক্তিকে সর্বাত্মক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজগণ বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে শঠতার মাধ্যমে পরাজিত করে বাংলাসহ ধীরে ধীরে গোটা উপমহাদেশ তারা পদানত করে।
মুসলমানগণের এই দুর্দিনে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলিম জাগরণের লক্ষ্যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র.)-এর দিক নির্দেশনামূলক শিক্ষা আন্দোলন সচেতন মুসলিম সমাজে নবজাগরণের বাতাস বইতে শুরু করে।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী (র.)-এর ইন্তেকালের পর তার চারজন সুযোগ্যপুত্র ও বহু সংখ্যক শাগরেদ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী (র.)-এর জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ আব্দুল আযীয (র.) ছিলেন পিতার যোগ্য উত্তরসূরী। তার বহুসংখ্যক শিষ্য পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিকাহ শাস্ত্রসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে পরাধীনতার করালগ্রাস থেকে মুসলিম জাতিকে মুক্ত করে শরীয়তের মূলভিত্তির ওপর দেশ পরিচালনার প্রেরণায় উজ্জীবিত হন।
এসব মনীষীদের মধ্যে শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি ও শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল (র.) ছিলেন অন্যতম। শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) ভারতকে ইসলামী হুকুমতের নিয়ন্ত্রণে আনায়নের লক্ষ্যে ইসলামবিরোধী ও ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সমগ্র ভারতব্যাপী প্রচারণা চলতে থাকে।
শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভির (র.) জ্বালাময়ী বক্তৃতায় মুসলমানদের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগ্রত হতে থাকে। তার সংগ্রামী প্রচারণার কঠিন কষাঘাতে মুসলিম জাতি অলসতার শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে থাকে।
প্রচার ও সাংগঠনিক কাজের সুবিধার্থে শাহ সৈয়দ (র.) গোটা ভারতকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে পৃথক পৃথক দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন। শাহ সৈয়দ ব্রেরলভি (র.) জিহাদ আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে বহু সংখ্যক শিষ্যসহ মক্কায় হজ্ব ও ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে গমন করেন। ঐ সময় আরব উপদ্বীপে মুহম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদীর নেতৃত্বে শিরক ও বিদআত বিরোধী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
ঐ আন্দোলন মূলত ছিল বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক আপোষহীন সংগ্রাম যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহকে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় বেনিয়াদের হাত থেকে মুক্তি অর্জনের পথ প্রশস্ত করে। শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) ঐ সংস্কার আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে ইসলামের কালজয়ী আদর্শের প্রতি আরো অধিক অনুরক্ত হয়ে ওঠে এবং মুক্তি সংগ্রামের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন।
ঐ সময়ই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের সংগ্রামী নেতা হাজী নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের সাথে শাহ সৈয়দ (র.)-এর পরিচয় ঘটে এবং এই দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনার প্রেরণা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুকরণে ভারতের মাটিতে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।
সারা উপমহাদেশ থেকে উৎসাহী যুবক ও ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেন। তার নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী মুজাহিদগণ ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রসিদ্ধ নগরী পেশোয়ার দখল করে শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) সেখানেই প্রধান কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন।
সৈয়দ আহমদের বাহিনীর সাথে কয়েকটি যুদ্ধে শিখ ও ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়। সারা ভারতের মুসলমানদের নিকট শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সম্মুখ সমরে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে টিকে উঠা সম্ভব নয় এ ভেবে বৃটিশ ও শিখ নরপতিগণ কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করলো।
মুসলমান সমাজে বিশ্বাসঘাতক তথা মোনাফেকদের অভাব কোন কালেই ছিল না। সীমান্তের প্রধান জমিদার ও গোত্রপতিগণকে ইংরেজ ও শিখ শাসকেরা বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করে ফেললো। মোনাফেক প্রধান সর্দারগণ মুজাহিদদের যাবতীয় তথ্যাদি ইংরেজ ও শিখদের নিকট গোপনে সরবরাহ করতে লাগলো এবং সুসংগঠিত মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ভাঙন সৃষ্টি করতে লাগলো।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শাহ সৈয়দ আহমদ (র.) ও মাওলানা শাহ ইসমাঈল এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পেশোয়ার থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মকেন্দ্র স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। এ সংবাদও মুনাফেক সর্দাররা দুশমনদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। মোক্ষম সুযোগ বুঝে শিখ সেনাপতি শেরসিংহ তার বিশাল বাহিনী নিয়ে মুজাহিদদের মূল ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) ও শাহ মাওলানা ইসমাঈল (র.)কে বালাকোটে আক্রমণ করে বসে। শহীদি মৃত্যু প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ মুজাহিদদ্বয় আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থে অতুলনীয় বীরদর্পে লড়াই করে শাহাদাতের অম্লান গৌরব অর্জন করেন।
১৮৩০ সালের ৬ মে বালাকোটের এই অসম সমরে শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভি (র.) তার সহযোদ্ধাসহ যেভাবে অতুলনীয় বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন তাতে মুতা, ইয়ামামা ও কারবালার শহীদদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ঐ দিন তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাদেরই প্রেরণায় ভারতে মুসলমানগণ আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক আবাসভূমি লাভে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
শাপলাচত্বরঃ
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ'র ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ শেষে লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ শাপলা চত্বরে অবস্থান নিলে গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে যৌথ অভিযান চালিয়ে সকালের আলো ফোটার আগেই পুরো এলাকা জনশূন্য করে ফেলে। সেই অভিযানে অসংখ্য লোক হতাহত হওয়ার দাবি করে হেফাজত
অপারেশন সিকিউর শাপলা[১] বা শাপলা চত্বর অভিযান হল ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ ই মে বাংলাদেশের ঢাকায় সংঘটিত ঘটনাসমূহ, যার মাধ্যমে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যপ্রসূত ইসলামী রাজনৈতিক জোট হেফাজতে ইসলামের একটি গনসমাবেশ এবং আন্দোলন এবং তাদেরকে বিতাড়িত করার জন্য সরকার কর্তৃক পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বিত বাহিনীর ব্যবহারকে বোঝানো হয়।[২][৩][৪] এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্যকারী "নাস্তিক ব্লগার"দের ফাসি কার্যকর করার জন্য একটি ব্লাসফেমি আইন প্রনয়ন এবং জনসম্মুখে "নারী পুরুষের মেলামেশা" নিষিদ্ধকরণ।[৫][৬][৭]
৬ই মে'র ভোররাত থেকে, সরকার কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই আন্দোলন কার্যক্রমের অভিমুখী দুটি চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়, যেগুলো অপারেশানের কার্যকলাপ সরাসরি সম্প্রচার করছিলো।[৮][৯][১০] মতিঝিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন সোমবার সকালে হেফাজতের লোকদের রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর নারায়ণগঞ্জ, হাঁটহাজারী এবং বাগেরহাট সহ দেশের বেশ কিছু স্থানে হেফাজত কর্মীদের কথিত হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হয়।[১১][১২][১৩] বিভিন্ন সূত্র থেকে অপারেশনে সঙ্ঘটিত হতাহতের সংখ্যা ও পরিস্থিতিকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়। অনেকগুলো সূত্র থকে ৩০ জনেরও অধিক নিহত হওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।[১১][১২][১৩][১৪][১৫]হেফাজত দাবি করে যে তাদের হাজারেরও অধিক কর্মী অভিযানে নিহত হয়েছে যা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকার'র জুন মাসের প্রতিবেদন, এবং সরকারি বিবৃতিসহ কোন মুক্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয় নি।[১১][১৬][১৭] সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী বিভাগীয় সংস্থাগুলো বহুসংখ্যক মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক উক্ত অভিযানে তাদের ভূমিকার জন্য কড়াভাবে সমালোচিত হয়।
শুধু ওপর থেকে নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিল পুলিশ-র্যাব-বিজিবি। একটা ‘ইয়েস কল’ আসার অপেক্ষা মাত্র। কলটি আসা মাত্রই ওরা নড়ছে না। তারপর ওপাশ থেকে যেই বলা হল- ‘আক্রমণে যাও’। এরপরে শুরু হলো সর্বাত্মক আক্রমন!! হাজার হাজার রাউন্ড গুলি টিয়ার গ্যাস ও গ্রেনেড ছুড়ে আগাতে থাকে যৌথবাহিনী।
দুই ঘটনায় মিলঃ
সম্ভবত ইতিহাসের একটি ঘুর্ণন বলা যায়। একই রকম ঘটনা ঘুরে ফিরে ঘটে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চরিত্রেও মিল দাঁড়িয়ে যায়। অনেক সময় ঘটে যায় দিন-তারিখেরও মিল। বেদনার ঘটনা, দুঃখের ঘটনায় এরকম মিল ঘটে গেলে মানুষের বুকে শোকের চর জেগে ওঠে। আবেগাকুল মানুষ তখন আগের ঘটনার সঙ্গে পরের ঘটনার আরও অনেক কিছুরই মিল খুঁজে দেখার চেষ্টা করে। অনেক সময় দুটি ঘটনার চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও মানের ক্ষেত্রে সমতা হয়তো থাকে না। কিন্তু উদ্দেশ্যগত মিল এবং দিন-তারিখ ও সংখ্যাতাত্ত্বিক অন্যান্য সাদৃশ্যের কারণে মিল খুঁজে পেয়ে সান্ত্বনা লাভের উপায় বের করারও চেষ্টা করে। সম্প্রতি এরকমই একটি ঘটনা ঘটে গেছে।
কষ্টের এই মিল, বেদনার এই সামঞ্জস্য কেউ প্রত্যাশা করেনি। অথচ কিছু মিল ও অমিল নিয়ে ঘটে গেছে সেটাই।
আজ থেকে ১৮২ বছর আগে ব্রিটিশ ভারতের সীমান্ত অঞ্চল বালাকোটে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী ঘটনার প্রতিচ্ছবি দাঁড়িয়ে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে : ঢাকার মতিঝিলে। সে ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৩১ সালের ৬ মে। এ ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৩ সালের ৬ মে। সেটি ঘটেছিল জুমাবারের দিনদুপুরে। এটি ঘটেছে সোমবার শেষরাতের বাতি নেভানো অন্ধকারে। সেটি ছিল যুদ্ধ, এটি ছিল নিরস্ত্র, ঘুমন্ত লাখো মানুষের অবস্থানে নির্বিচার আক্রমণ। ওই ঘটনায় ৭০০ মুসলিম মুজাহিদের মধ্যে শহীদ হয়েছিলেন ৩০০ জন। আর এই ঘটনায় (সরকারি বিবরণ অনুযায়ী কেউ হতাহত হয়নি) ২৫০০ থেকে ৩০০০ মানুষ ‘নিহত’ হয়েছেন বলে দাবি উঠেছে। ওই ঘটনায় আক্রান্ত মুসলমানরা ছিলেন ভিনজাতির মানুষের সঙ্গে লড়াইরত। আর এ ঘটনায় স্বজাতির কয়েকটি বাহিনী তাদের ওপর হামলে পড়েছে।
বালাকোট আন্দোলনের মূল কথা ছিল-কুসংস্কার থেকে ইসলামী চিন্তা ও আমল রক্ষা, তাওহীদবাদী নিখাঁদ আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ও ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার সংগ্রাম। ওই আন্দোলনের নাম ছিল তরিকায়ে মুহাম্মদী। ইতিহাসের সূত্র অনুযায়ী, ওই যুগের গ্রহণযোগ্য সব আলেম ও ইসলামপন্থী মানুষ ওই আন্দোলনের প্রতি সমর্থক ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। আর এই আন্দোলনের মূল কথা হচ্ছে, সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন, ইসলামবিরোধী উগ্র নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদন্ডের আইন প্রণয়ন করে শাস্তিদান এবং ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবনাচারের বিকাশ। এই আন্দোলনের নাম হেফাজতে ইসলাম। এই আন্দোলনের সঙ্গেও দেশের সমকালের সত্যপন্থী গ্রহণযোগ্য সব আলেম ও সব পর্যায়ের মুসলমানরা সহানুভূতিশীল রয়েছেন বলে গণমাধ্যমে এসেছে।
ইসলাম, স্বাধীনতা ও স্বজাত্যবোধের বিবেচনায় এই দুটি আন্দোলনের মাঝে মিল অনেক। নেতৃত্বের প্রধান অংশের বৈশিষ্ট্য ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের দিক থেকেও দুটি আন্দোলনের মাঝে মিল কম নেই। এমনকি ট্র্যাজেডি ও বিপর্যয়ের দিক থেকেও তেমন অমিল পাওয়া যায় না। কেবল বিপর্যয়-পরবর্তী প্রতিরোধের ঘটনার বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত। এটি বলতে পারবে হয়তো আগামী দিনের ইতিহাস।
ইসলামী বিশ্বকোষ (১৬ শ’ খন্ড-১ম ভাগ, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা : ৪৫, ৪৬, ৪৭)-এর বিবরণ অনুযায়ী ওই ঘটনায় মুসলমানদের বিপক্ষে শিখনেতা শের সিংয়ের বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল ১০ হাজার। মতিঝিলের এ ঘটনাতেও নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলাকারীদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার।
ওই ঘটনায় হতাহত মুসলমানদের অনেকের লাশ ও তাদের সঙ্গের অমূল্য ঐতিহাসিক সামানপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এ ঘটনায় (জোর অভিযোগ উঠেছে) ‘নিহতদের’ লাশ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।
ওই ঘটনার যিনি প্রধান ছিলেন তাঁর নাম ছিল সাইয়েদ আহমদ শহীদ, আর এই কাফেলার যিনি প্রধান তাঁর নাম শাহ আহমদ শফী।
তবে তার মধ্যেও পার্থক্য একটা ছিল। বালাকোটের ঘটনায় লাশের অবমাননা ও ধ্বংসযজ্ঞের কাজটি করা হয় তিন দিন পর। আক্রমণকারী শিখদের মূল বাহিনী বালাকোট ত্যাগ করার পর চরম বিদ্বেষী কিছু শিখ সেনার হাতে এসব ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। এর আগের চিত্রটি ছিল অন্য রকম। যুদ্ধ শেষে সেনাপতি শের সিং সেনাদের দিয়ে সাইয়েদ আহমদ শহীদের লাশ খুঁজে বার করান। তখন তার দেহ ছিল মস্তক থেকে বিচ্ছিন্ন। শের সিং ওই লাশ সম্মানের সঙ্গে দাফনের জন্য স্থানীয় মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ জানান। নিজে ওই লাশের ওপর একটি চাদর বিছিয়ে দেন। আর এ ঘটনায় ‘নিহতদের’ লাশের প্রতি আক্রমণকারী স্বজাতির সেনাদের ন্যূনতম সম্মান প্রকাশের কোনো ঘটনা কেউ শুনেনি। বরং গায়েব হয়ে যাওয়া হাফেয আলেমের লাশগুলোর প্রতি ভয়ংকর অবমাননা ও অসদাচরণের গল্প এখন সারা দেশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা জেলার কুনহার নদীর পাশে ছিল বালাকোটের অবস্থান। একটি উঁচু ময়দান। কোনো জনবসতি সেখানে ছিল না। তার পাশেই ছিল মাট্টিকোট পাহাড়।
ওই পাহাড় থেকেই শিখ আক্রমণকারী বাহিনী হামলা করে। আর এ ঘটনাটির অবস্থান স্বাধীন দেশ-ঢাকার হৃদপিন্ড; মতিঝিল। চারপাশে অফিসভবন, ব্যস্ত নগর, তামাশার সভ্যতা। ওই ঘটনায় যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা চাপা দেওয়ার কোনো চেষ্টা কেউ করেনি। আর এই ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন তাদের ‘শহীদ’ বলে উচ্চারণ করাই মুশকিল হয়ে গেছে। আর ‘নিহতদের’ ব্যাপারে বলা হচ্ছে, কেউ হতাহত হয়নি। এ ঘটনায় ‘শান্তিপূর্ণ, দক্ষতাপূর্ণ ও বিচক্ষণতাপূর্ণ’ অভিযান চালানো হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদসহ সরকারপন্থী নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
ওই ঘটনার পর ইতিহাস তাদের জন্য যুগে যুগে কেঁদেছে, সাড়া দিয়েছে, প্রতিরোধ গড়েছে। আর এই ঘটনার পর নিঃশব্দে চোখের পানি মুছতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
তবে, একটা ক্ষেত্রে আগের ও পরের ঘটনায় অদ্ভুৎ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে আক্রান্ত মুসলমানদের প্রতি চরম মিথ্যাচার ও বিদ্বিষ্ট বিষোদগার। ওই ঘটনার প্রায় তিন যুগ পর ব্রিটিশ সিভিলিয়ান হান্টারের লেখায় সাইয়েদ আহমদ শহীদকে ‘দস্যু ও ডাকাত সর্দার’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এ ঘটনার তিন দিন পর হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও সচিবালয়ে লুটপাট চালানোর নিশ্চিত তথ্য ছিল’ বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। বেদনাদায়ক ও হাস্যকর!
অদ্ভুত রুদ্ধবাক বেদনার এক ভুবনে ডুবে আছে সারাদেশ। কেউ জানে না এ কষ্টের শেষ কোথায়? ৭ মে হাটহাজারীর সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে বেদনাঘন যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, সংবাদপত্রে সেটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তবে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষা এবং ইসলামবিদ্বেষী উগ্র নাস্তিকদের বিচার চাওয়ার ‘অপরাধে’ চালানো এই অভিযানের বারুদ ধর্মপ্রাণ মানুষের বুকে কত যুগ আগুনের মতো জ্বলতে থাকবে- সে ধারণা হয়তো এখনই করা মুশকিল। এখন তো মানুষ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। কোটি মজলুমের কপোল আর বুকে নোনা পানির স্রোত। তাদের মুনাজাতের হাত আরশের দিকে উঠানো। মজলুমের এই হাহাকারভরা ফরিয়াদে কখন কেঁপে উঠবে আল্লাহর আরশ, আকাশ-বাতাস, বান্দা কীভাবে তা বলবে?