20 February 2017

রক্তে কেনা বাংলা ভাষার মূল্যায়ন কি করছি আমরা?

মনের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম আকুতি প্রকাশের জন্য আমরা মুখে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষা। ভাষাকে আল্লাহ তায়ালা তার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তার এক নিদর্শন হলো, তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা।’ ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাকহীন নিথর কোনো ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিসহ তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে
দান করেছেন ভাষার নেয়ামত। সব প্রাণিরই স্ব স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এতো স্বচ্ছন্দ, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনো প্রাণির নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মাহাত্ম্য।
মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবীদের মাতৃভাষায় করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি যাতে তাদেরকে আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে।’ (সুরা ইবরাহীম) নবীদের জীবনী পর্যালোচনা করলে জানা যায় তারা প্রত্যেকেই ছিলেন মাতৃভাষার পণ্ডিত।
পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও ঐহিত্যম-িত ভাষাভাষী আমরা। গর্বের ধন এ ভাষার জন্য আমাদের রক্ত ঝরাতে হয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। পৃথিবীতে একমাত্র জাতি আমরা যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। এজন্য পৃথিবীর সব ভাষার চেয়ে আমাদের মাতৃভাষা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এ কারণেই সারা বিশ্বে ভাষা হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের বাংলা। আজ সারা বিশ্ব জানে বাংলা নামক একটি ভাষা আছে এবং এই ভাষাটি অর্জিত হয়েছে সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে। জাতিসংঘ আমাদের ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু আমাদের নয় সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। সুতরাং বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের গর্বের জায়গাটি অনেক ঊর্ধ্বে। এই ভাষার প্রতি আমাদের মমতাবোধও সবার উপরে থাকার কথা। কিন্তু আসলেই কি আমাদের রক্তে কেনা এই ভাষার প্রতি সঠিক মমতাবোধ রয়েছে?
ভাষা সংগ্রামের ৬৫ বছর পরে এসেও আমাদের মাতৃভাষার মূল্যায়ন নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য লজ্জার।
ভাষা দিবস ৮ ফাল্গুন নয় কেন?
প্রতি বছর আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস পালন করি। কিন্তু যে ভাষার জন্য আমাদের এতো ত্যাগ সেই ভাষার নিজস্ব একটি পঞ্জিকা আছে।
সেই পঞ্জিকা অনুযায়ী ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৮ ফাল্গুন। আমরা সেই ৮ ফাল্গুন কেন মাতৃভাষা দিবস পালন করি না এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। শুধুই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলেতি পারি’ গানটির জন্য ইংরেজি তারিখে দিবসটি পালনের কোনো যুক্তি হতে পারে না। এটা আমাদের ভাষার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা নয় কি? ভাষার মাসে আমাদের বাংলা একাডেমি বইমেলার আয়োজন করে থাকে। সেটা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে না করে ফাল্গুন মাসজুড়েও তো করতে পারতো। এতে আমরা যে ভাষার প্রতি প্রাণ দিয়েছি সেই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও বাড়তো।
সরকারিভাবেই আজ বাংলা ভাষা চর্চার প্রতি তেমন গুরুত্ব নেই। তারিখ গণনায় সবখানে দখল করে আছে ইংরেজি। একমাত্র পয়লা বৈশাখ ছাড়া কোথাও বঙ্গাব্দকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এমনকি বছরের বেশির ভাগ সময় আমরা জানিই না বাংলা কোন মাস চলছে এবং আজ কত তারিখ। অনেক জায়গায় উপস্থিত কুইজ প্রতিযোগিতায় দেখা গেছে আজ বাংলা মাসের কত তারিখ এটা কেউ বলতে পারে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আমরা বাংলা কোন মাস চলছে এবং কত সন সেটাও ভুল করি। এটা হলো মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতার একটি আলামত।
মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা
চড়া মূল্য দিয়ে মাতৃভাষা অর্জন করলেও আমাদের এই ভাষার প্রতি রয়েছে চরম উদাসীনতা। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও মাতৃভাষার সঠিক চর্চা হয় না।
তথাকথিত আধুনিক যে প্রজন্ম গড়ে উঠছে তারা কথায় কথায় ইংলিশ বুলি আওড়ায়। স্বাভাবিক কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দ টেনে এনে নিজেদেরকে অধিক স্মার্ট বোঝানোর চেষ্টা করে। বাংলার চিরাচরিত অনেক শব্দ আজ বিলুপ্তির পথে। শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য বাংলা পড়া ছাড়া এর তেমন কোনো চর্চা হয় না বললেই চলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যান্য বিষয়ের প্রতি যে গুরুত্ব দেয়া হয় অনেক ক্ষেত্রে বাংলার প্রতি ততটা দেয়া হয় না। এতে দিন দিন বাংলা চর্চার ধারা ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে।
আজকাল এফএম রেডিও কালচার বাংলা ভাষার চরম ক্ষতি করছে। এখানে বাংলা ভাষা একটি বিকৃত রূপ পাচ্ছে। না বাংলা না ইংলিশ মাঝামাঝি একটি ‘বাংলিশ’ চর্চা করছে তরুণ প্রজন্ম। বাংলায় কথা বলার সময়ও একটি ইংরেজি ভাব নিয়ে আসা হাল জমানার ছেলেমেয়েদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হাজার বছরের ঐতিহ্য যে ভাষাটির সেই ভাষা বিকৃত করে নতুন রূপ দেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও এ ব্যাপারে খুব একটা সোচ্চার না। এভাবে ভাষার ব্যবহারে নৈরাজ্য চলতে থাকলে 
বাংলা ভাষা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
ভাষা শহীদদের প্রতি অবিচার
নিজেদের অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যারা আমাদের জন্য ভাষা অধিকার এনে দিয়ে গেছেন তাদের প্রতিও কি আমরা সুবিচার করছি? আমরা কি তাদেরকে যথার্থভাবে স্মরণ করছি?
বছরের একদিন ২১ ফেব্রুয়ারি তাদের জন্য খালি পায়ে প্রভাতফেরি করাই কি তাদের প্রতি সম্মান দেখানো? তাদের জীবন-কর্ম, আদর্শ ও ত্যাগ সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম কতটুকু জানতে পারছে? ভাষা সংগ্রামের ওপর বিভিন্ন কাজ হলেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের কতটুকু ভেতরে?
সবচেয়ে বড় হলো ভাষা শহীদদের জন্য আমরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে নীরবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে সম্মান দেখানোর যে চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি সেটা আসলে কতটুকু যৌক্তিক? এক মিনিটের এই বোবা কালচার কেন? কী লাভ এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলে? ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা মুসলমান। পরকালে তাদের বিশ্বাস ছিল। ঈসালে সওয়াব করলে তাদের রূহে তা পৌঁছবে। সুতরাং এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা কি পারি না একটু কুরআন তেলাওয়াত করে তাদের রূহে এর সওয়াব পৌঁছে দিতে।
আসলে আমরা পশ্চিমা কালচারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞানও আমাদের থাকে না। একটি শিশুও এটা বোঝার কথা যে, নীরবে এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে কোনো লাভ নেই। অথচ আমরা সংসদেও দেখি বিশিষ্টজন কেউ মারা গেলে তার জন্য সবাই মূর্তির মতো বোবা হয়ে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মুসলমান হলে সেই সময়টুকু সবাই একটু দোয়া-কালাম করলে কি তার ফায়দা হতো না। নিছক ফটোসেশনের জন্য বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে ভাষা শহীদদের জন্য দোয়া-দুরুদের মাধ্যমে ঈসালে সওয়াব করাই হলো প্রকৃত ভাষাপ্রেমিকদের কাজ।
মাতৃভাষা চর্চা ইবাদততুল্য
সংস্কৃতির অন্যতম বাহন ভাষা। আর ধর্ম হলো সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান। ভাষাকে বাহন করে যে সংস্কৃতি বিকশিত হয় তাতে ধর্মীয় ছাপটা মোটাদাগে ধরা পড়ার কথা। এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাসের ছোঁয়া লেগেছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে। আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে ইসলামি আবহের স্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন ছাপ যেমন পরিলক্ষিত হয় তেমনি এদেশের ভাষাও তা থেকে মুক্ত নয়। মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের ঐকান্তিকতা ও সাধনায় আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমানিত্বের প্রভাবটা দিন দিন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। নিজেদের অজান্তেই নিরেট ইসলাম ও মুসলিমবান্ধব অগণিত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলা ভাষায়। তাছাড়া আরবি, ফারসি ও র্উর্দু ভাষার ভা-ার থেকে আহরিত যে সম্পদ আজ বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ হিসেবে গণ্য হচ্ছে তা মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকদের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। সংস্কৃত থেকে বাংলার মূল উৎপত্তিস্থলটার কথা বাদ দিলে বাংলা ভাষা বিকাশের পরবর্তী প্রতিটি বাঁকে মুসলিম মনীষীদের অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল এর নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম পণ্ডিতেরা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সেই বীরদের অবদান চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে।
প্রত্যেক জাতির ভাষা জাতীয় সম্পদ। ভাষার বিকাশ ও চর্চায় সে ভাষাভাষী সব শ্রেণির মানুষের সক্রিয় ভূমিকা থাকে। কোনো ভাষাই একক কোনো গোত্র-গোষ্ঠীর কৃতিত্বের ফসল নয়। সে হিসেবে বাংলা ভাষাও আমাদের সার্বজনীন ভাষা। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের কাছে তার ভাষা মায়ের মতোই আপন। নিজের মাকে সম্মান কিংবা অবজ্ঞা করা কোনো ধর্মই যেমন স্বীকৃতি দেয় না তেমনি মাতৃভাষার মর্যাদাহানিও কোনো ধর্মই মেনে নিতে পারে না। মানবপ্রকৃতির ধর্ম ইসলাম এক্ষেত্রে আরও বেশি রক্ষণশীল। সুতরাং ইসলামকে যারা নিজেদের বোধ ও বিশ্বাসে লালন করেন তাদের জন্য উচিত নিজেদের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আরও বেশি আন্তরিক হওয়া। দাওয়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা চর্চা করা ইবাদতও বটে। কেউ মাতৃভাষায় দীনকে বিকশিত করার নিয়তে বাংলা চর্চা করলে অবশ্যই এর জন্য সওয়াব পাবে।
গতিশীল হোক আলেমদের ভাষাচর্চা
আমাদের মাতৃভাষার সঙ্গে এদেশের আলেমসমাজের একটা দূরত্ব ছিল দীর্ঘকাল পর্যন্ত। এই ভাষায় হিন্দুত্বের ছাপ এমন দোহাই দিয়ে আলেমরা আরবি-উর্দু-ফারসি চর্চায় ছিলেন বেশি মনোযোগী। এজন্য মাতৃভাষা চর্চায় আলেমরা অনেক পিছিয়ে আছেন সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে বোধোদয় হয়েছে এদেশের আলেমদের। বিগত দুই দশক ধরে মাতৃভাষা চর্চায় আলেমরাও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছেন। আরবি-উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন। বিশেষ করে নবীন আলেমদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চার ব্যাপক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশ ও জাতির নির্ভরতার প্রতীক আলেমরা সঠিক ভাষা চর্চা করলে মাতৃভাষার মূল্যায়ন হবে সেট সবার বিশ্বাস।
আলেমরা মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগী হলেও এখনও তারা অনেকটা পিছিয়ে আছেন। অনেক দেরিতে শুরু করার কারণে সেই ক্ষতি তারা এখনও পুষিয়ে উঠতে পারছেন না। তবে দিন দিন যেভাবে লেখালেখি ও সাহিত্য চর্চায় আলেমদের উপস্থিতি বাড়ছে তাতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেশি সময় লাগবে না। এভাবে মাতৃভাষা চর্চায় অব্যাহতভাবে লেগে থাকলে এদেশে মাতৃভাষার নেতৃত্বও আলেমদের হাতে আসতে পারে-সেটা অসম্ভব কিছু নয়।