বর্তমান মিয়ানমারের সাবেক নাম বার্মা। অনুরূপ বর্তমান রাখাইন প্রদেশের সাবেক নাম আরাকান। একসময় আরাকান স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। এখন এটি মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। আরাকান নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এবং মূল ভূখণ্ড মিয়ানমার থেকে পাহাড় দিয়ে বিচ্ছিন্ন। অতীতে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে আরাকান বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে আরাকান পার্বত্য জেলা এবং দক্ষিণের বেশির ভাগ অঞ্চল আরাকান থেকে পৃথক করায় বর্তমানে আরাকানের আয়তন ১৪ হাজার ২০০ বর্গমাইল। বেসরকারি হিসাব মতে, আরাকানের লোকসংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি। বর্তমানে প্রদেশটিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের সংখ্যা প্রায়
কাছাকাছি। এ প্রদেশটিতে রাখাইন ও রোহিঙ্গা ছাড়াও প্রায় দুই লক্ষাধিক চাকমা, কামাইস ও বার্মান নাগরিক রয়েছে।
মিয়ানমারের ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছিল। মিয়ানমারের ৭০ লাখ মুসলমানের অর্ধেকের বেশি আরাকানের অধিবাসী। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ শাসকে শাসন করেছেন।
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনদের হাতে অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নিবন্ধনহীন শরণার্থী হিসেবে বাস করছে। ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার জেলায় যে দু’টি শরণার্থী শিবির পরিচালনা করছে, এ দু’টিতে নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার। মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সেনাসমর্থিত থিন সেনের সরকারের সময় রোহিঙ্গা শব্দটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এ সম্প্রদায়টি বাঙালি নামে অভিহিত হবে মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও থিন সেনরা এগুলোর থোড়াই তোয়াক্কা করেন। আজ এরা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের শুধু ধর্মবিশ্বাসের জন্য যেভাবে নৃশংসভাবে হত্যাসহ নিগৃহীত ও উৎপীড়ন করছেন, তা ইতিহাসে বিরল।
বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গারাই হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যাগুরুদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। মহামতি বুদ্ধের অহিংস নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু জন-অধ্যুষিত ভারতবর্ষের লাখ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তন-পরবর্তী সময়ে বলা হতোÑ জীব হত্যা মহাপাপ। বর্তমানে গোঁড়া বৌদ্ধরা নিরামিষভোজী হলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বেশির ভাগই জীব হত্যা মহাপাপের নীতি থেকে সরে এসে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে পরম তৃপ্তির সাথে জীবের মাংস ভক্ষণ করছে। যে নৃশংসতায় আরাকানে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিধনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে, তাতে এদের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলার অবকাশ আছে কি না, সে বিষয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী নয়। তারা চটগ্রাম থেকে দেশান্তর হয়ে মিয়ানমারে যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় এক হাজার বছর ধরে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করে আসছে। ১৭৮৫ সালে বার্মার রাজা বোদাপাউয়া আরাকান দখল করলে সেখান থেকে ব্যাপক হারে মগ ও রোহিঙ্গা চট্টগ্রামে দেশান্তর হয়। বোদাপাউয়ার বাহিনী আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্দয়ভাবে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন করে এবং সে সময় জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে অনেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বার্মা ব্রিটিশদের দখলে এলে দীর্ঘ দিন চট্টগ্রামাঞ্চলে নির্বাসনে থাকা রোহিঙ্গারা আবার তাদের মাতৃভূমি আরাকানে প্রবেশ করে। বার্মা ব্রিটিশদের অধীনে আসার পর এটিকে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে বার্মাকে ব্রিটিশ-ভারত থেকে পৃথক করা হয়। সে সময় রোহিঙ্গারা আধিপত্যবাদের শিকড় থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বার্মাকে ভারতবর্ষ থেকে পৃথক করার পর ১৯৩৮ সালে আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম মারাত্মক দাঙ্গা হয় এবং সেই দাঙ্গা আজো অব্যাহত আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় বার্মার উগ্র জাতীয়তাবাদীরা জাপানিদের বার্মা দখল সমর্থন করে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে রত হয়। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা পুনর্দখল করলে রোহিঙ্গাদের আবার তাদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে আসার সুযোগ ঘটে। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময় বার্মার শাসক ছিলেন বর্তমান বার্মার তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি’র বাবা অং সান। অং সান তার শাসনামলে এক আদেশ বলে রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অং সানকে হত্যার পর সামরিক শাসক উনু তার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে থাকেন এবং তার শাসনামলেও রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও মৌলিক অধিকার অক্ষুণœ থাকে। সামরিক শাসক নেউইন ক্ষমতাসীন হলে আবার রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয় এবং ১৯৬২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের উৎখাতের নামে গণহত্যা চলতে থাকে। নেউইন রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। সে সময় থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের দেশান্তর হওয়া শুরু হয় এবং ১৯৭৮ সালে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে দেশান্তর হওয়ার বিষয়টি জাতিসঙ্ঘসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সহানভূতি অর্জনে সমর্থ হয় এবং যদিও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় তাদের আরাকানে প্রত্যাবাসন শুরু হয়, কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সে অনুপ্রবেশ আজো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এলেও জাতিসঙ্ঘ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, জাতিসঙ্ঘ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তাদের ফেরত নিতে বাধ্য করা এবং আবার যেন সেখানে অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বর্তমানে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক। মিয়ানমারে তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকারÑ এ দু’টির কোনোটিই নেই। রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। বাংলাদেশ যেকোনো সাময়িক দুর্ঘটনা ও স্বল্পকালের জন্য রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু অতীতের ঘটনাবলি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিরাপত্তাহীনতার কারণে ও উৎপীড়নের ভয়ে অবৈধভাবে যে বিপুল মুসলিম রোহিঙ্গার শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ ঘটেছে, তাদের নগণ্যসংখ্যক মিয়ানমারে ফিরে যেতে পেরেছে।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ভাতৃপ্রতিম রোহিঙ্গাদের সমস্যার ব্যাপারে অবহিত এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বর্তমানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এমন অনেক রোহিঙ্গা আছে, যারা ’৫০ ও ’৬০-এর দশকে সৌদি আরব গিয়েছে, তাদের অনেকে সেখানকার নাগরিকত্বও লাভ করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রবিহীন হওয়ায় মিয়ানমার থেকে বৈধভাবে তাদের পক্ষে পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম অবৈধভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু অসাধু রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা অবৈধ অর্থে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি ও বিদেশে যেতে সহায়তা করে আসছেন। এমন অনেক অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী রয়েছে, যারা দীর্ঘ দিন এ দেশে বসবাসের কারণে এ দেশের বাঙালিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে আরাকানের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রত্যাবর্তন অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের সংবিধানে যেকোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যারা ১৮২৩ সাল থেকে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত; কিন্তু রহস্যজনকভাবে এ সংজ্ঞায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভ্ক্তু করা হয়নি। এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রধান সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) অভিমত, রোহিঙ্গাদের অধিকারবঞ্চিত করে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হলে মিয়ানমারে বসবাসরত অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অবকাশ কোথায়? আরএসও-এর নেতৃবৃন্দ জোর দিয়ে বলেন, জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত কোনো রাষ্ট্রের নিজ দেশের নাগরিকদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অভিহিত করে তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে কাউকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়া মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং জাতিসঙ্ঘের উচিত এ ধরনের দ্বৈতনীতি অবলম্বনকারী দেশকে জাতিসঙ্ঘের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা। মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি রহস্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের উৎপীড়ন ও নিপীড়ন বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তার ভয়, তিনি রোহিঙ্গাদের ন্যায্য ও আইনসঙ্গত অধিকারের প্রতি সমর্থন জানালে তিনি ব্যাপক হারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর ভোটপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। অং সান সু চি’র এ ধরনের আচরণ আদৌ গণতন্ত্রের সপক্ষের শক্তি কি না এবং তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত হয়েছে, সে ধরনের প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী এখানে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বাস করে আসছে। এখানে দু-একটি বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হলেও তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ও দাঙ্গা এক নয়। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ইতিহাসকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গারা অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, তা কোনো সভ্য দেশের পরিচায়ক নয়। আর তাই বিশ্বে মিয়ানমার নিজেকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দেখতে চাইলে, তাকে অবশ্যই রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ করে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এর অন্যথায় রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেয়ার দায় মিয়ানমারের শাসনকার্য পরিচালনায় যারা ন্যস্ত, তারা কি এড়াতে পারবেন?
কাছাকাছি। এ প্রদেশটিতে রাখাইন ও রোহিঙ্গা ছাড়াও প্রায় দুই লক্ষাধিক চাকমা, কামাইস ও বার্মান নাগরিক রয়েছে।
মিয়ানমারের ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছিল। মিয়ানমারের ৭০ লাখ মুসলমানের অর্ধেকের বেশি আরাকানের অধিবাসী। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ শাসকে শাসন করেছেন।
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনদের হাতে অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নিবন্ধনহীন শরণার্থী হিসেবে বাস করছে। ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার জেলায় যে দু’টি শরণার্থী শিবির পরিচালনা করছে, এ দু’টিতে নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার। মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সেনাসমর্থিত থিন সেনের সরকারের সময় রোহিঙ্গা শব্দটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এ সম্প্রদায়টি বাঙালি নামে অভিহিত হবে মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও থিন সেনরা এগুলোর থোড়াই তোয়াক্কা করেন। আজ এরা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের শুধু ধর্মবিশ্বাসের জন্য যেভাবে নৃশংসভাবে হত্যাসহ নিগৃহীত ও উৎপীড়ন করছেন, তা ইতিহাসে বিরল।
বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গারাই হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যাগুরুদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। মহামতি বুদ্ধের অহিংস নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু জন-অধ্যুষিত ভারতবর্ষের লাখ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তন-পরবর্তী সময়ে বলা হতোÑ জীব হত্যা মহাপাপ। বর্তমানে গোঁড়া বৌদ্ধরা নিরামিষভোজী হলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বেশির ভাগই জীব হত্যা মহাপাপের নীতি থেকে সরে এসে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে পরম তৃপ্তির সাথে জীবের মাংস ভক্ষণ করছে। যে নৃশংসতায় আরাকানে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিধনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে, তাতে এদের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলার অবকাশ আছে কি না, সে বিষয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী নয়। তারা চটগ্রাম থেকে দেশান্তর হয়ে মিয়ানমারে যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় এক হাজার বছর ধরে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করে আসছে। ১৭৮৫ সালে বার্মার রাজা বোদাপাউয়া আরাকান দখল করলে সেখান থেকে ব্যাপক হারে মগ ও রোহিঙ্গা চট্টগ্রামে দেশান্তর হয়। বোদাপাউয়ার বাহিনী আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্দয়ভাবে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন করে এবং সে সময় জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে অনেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বার্মা ব্রিটিশদের দখলে এলে দীর্ঘ দিন চট্টগ্রামাঞ্চলে নির্বাসনে থাকা রোহিঙ্গারা আবার তাদের মাতৃভূমি আরাকানে প্রবেশ করে। বার্মা ব্রিটিশদের অধীনে আসার পর এটিকে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে বার্মাকে ব্রিটিশ-ভারত থেকে পৃথক করা হয়। সে সময় রোহিঙ্গারা আধিপত্যবাদের শিকড় থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বার্মাকে ভারতবর্ষ থেকে পৃথক করার পর ১৯৩৮ সালে আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম মারাত্মক দাঙ্গা হয় এবং সেই দাঙ্গা আজো অব্যাহত আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় বার্মার উগ্র জাতীয়তাবাদীরা জাপানিদের বার্মা দখল সমর্থন করে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে রত হয়। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা পুনর্দখল করলে রোহিঙ্গাদের আবার তাদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে আসার সুযোগ ঘটে। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময় বার্মার শাসক ছিলেন বর্তমান বার্মার তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি’র বাবা অং সান। অং সান তার শাসনামলে এক আদেশ বলে রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অং সানকে হত্যার পর সামরিক শাসক উনু তার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে থাকেন এবং তার শাসনামলেও রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও মৌলিক অধিকার অক্ষুণœ থাকে। সামরিক শাসক নেউইন ক্ষমতাসীন হলে আবার রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয় এবং ১৯৬২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের উৎখাতের নামে গণহত্যা চলতে থাকে। নেউইন রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। সে সময় থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের দেশান্তর হওয়া শুরু হয় এবং ১৯৭৮ সালে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে দেশান্তর হওয়ার বিষয়টি জাতিসঙ্ঘসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সহানভূতি অর্জনে সমর্থ হয় এবং যদিও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় তাদের আরাকানে প্রত্যাবাসন শুরু হয়, কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সে অনুপ্রবেশ আজো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এলেও জাতিসঙ্ঘ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, জাতিসঙ্ঘ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর উচিত মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তাদের ফেরত নিতে বাধ্য করা এবং আবার যেন সেখানে অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বর্তমানে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক। মিয়ানমারে তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকারÑ এ দু’টির কোনোটিই নেই। রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। বাংলাদেশ যেকোনো সাময়িক দুর্ঘটনা ও স্বল্পকালের জন্য রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু অতীতের ঘটনাবলি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিরাপত্তাহীনতার কারণে ও উৎপীড়নের ভয়ে অবৈধভাবে যে বিপুল মুসলিম রোহিঙ্গার শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ ঘটেছে, তাদের নগণ্যসংখ্যক মিয়ানমারে ফিরে যেতে পেরেছে।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ভাতৃপ্রতিম রোহিঙ্গাদের সমস্যার ব্যাপারে অবহিত এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বর্তমানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এমন অনেক রোহিঙ্গা আছে, যারা ’৫০ ও ’৬০-এর দশকে সৌদি আরব গিয়েছে, তাদের অনেকে সেখানকার নাগরিকত্বও লাভ করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রবিহীন হওয়ায় মিয়ানমার থেকে বৈধভাবে তাদের পক্ষে পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম অবৈধভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু অসাধু রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা অবৈধ অর্থে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি ও বিদেশে যেতে সহায়তা করে আসছেন। এমন অনেক অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী রয়েছে, যারা দীর্ঘ দিন এ দেশে বসবাসের কারণে এ দেশের বাঙালিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে আরাকানের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রত্যাবর্তন অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের সংবিধানে যেকোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যারা ১৮২৩ সাল থেকে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত; কিন্তু রহস্যজনকভাবে এ সংজ্ঞায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভ্ক্তু করা হয়নি। এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রধান সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) অভিমত, রোহিঙ্গাদের অধিকারবঞ্চিত করে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হলে মিয়ানমারে বসবাসরত অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অবকাশ কোথায়? আরএসও-এর নেতৃবৃন্দ জোর দিয়ে বলেন, জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত কোনো রাষ্ট্রের নিজ দেশের নাগরিকদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অভিহিত করে তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে কাউকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়া মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং জাতিসঙ্ঘের উচিত এ ধরনের দ্বৈতনীতি অবলম্বনকারী দেশকে জাতিসঙ্ঘের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা। মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি রহস্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের উৎপীড়ন ও নিপীড়ন বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তার ভয়, তিনি রোহিঙ্গাদের ন্যায্য ও আইনসঙ্গত অধিকারের প্রতি সমর্থন জানালে তিনি ব্যাপক হারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর ভোটপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। অং সান সু চি’র এ ধরনের আচরণ আদৌ গণতন্ত্রের সপক্ষের শক্তি কি না এবং তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত হয়েছে, সে ধরনের প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী এখানে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বাস করে আসছে। এখানে দু-একটি বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হলেও তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ও দাঙ্গা এক নয়। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ইতিহাসকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গারা অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, তা কোনো সভ্য দেশের পরিচায়ক নয়। আর তাই বিশ্বে মিয়ানমার নিজেকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দেখতে চাইলে, তাকে অবশ্যই রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ করে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এর অন্যথায় রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেয়ার দায় মিয়ানমারের শাসনকার্য পরিচালনায় যারা ন্যস্ত, তারা কি এড়াতে পারবেন?