বিশ্ব মা দিবস : জেনে নিন ইসলামে মাতা-পিতার মর্যাদা ও গুরুত্ব, জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য
পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে মা।
জগৎ সংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে যে মানুষটির একটু সান্ত্বনা আর স্নেহ-ভালোবাসা আমাদের সমস্ত বেদনা দূর করে দেয় তিনিই হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দুঃখে-কষ্টে, সংকটে-উত্থানে যে মানুষটি স্নেহের পরশ বিছিয়ে দেয় তিনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন মা। প্রত্যেকটি মানুষ পৃথিবীতে আসা এবং বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা মায়ের। মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না। মা হচ্ছেন জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ন্যায় ও সমতার ধর্ম ইসলাম মায়ের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইসলাম মাকে উচ্চাসনে স্থান দিয়েছে। ইসলামের ঘোষণা হচ্ছে, মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত। মায়ের সেবা শুশ্রুষার দ্বারা জান্নাতের হকদার হওয়া যায়। বাবার তুলনায় ইসলাম মায়ের অধিকার অধিক ঘোষণা করেছে। এক সাহাবী রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, আমার সুন্দর ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? আল্লাহর রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, তোমার মা। সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমার মায়ের পরে আমি কার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করব? আল্লাহর নবী তাগিদ দেয়ার জন্য বললেন, তোমার মায়ের পরেও তোমার মায়ের অধিকার পালন করতে হবে। তার সঙ্গে সুন্দর আচরণ তোমাকে করতে হবে। এভাবে তিনবার আল্লাহর রাসুল (সা.) মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করার কথা বলেছেন। চতুর্থবার বলেছেন, অতঃপর তুমি তোমার বাবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করবে। এ জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ ব্যতীত যদি কাউকে সেজদা করার নির্দেশ হতো, তবে সন্তানকে নির্দেশ দেয়া হতো তার মাকে সেজদা করার জন্য। মায়ের পায়ের নিচেই আপনার জান্নাত। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) পরিণত বয়সে মায়ের সান্নিধ্য পাননি। এ জন্য তিনি আফসোস করতেন। মায়ের সেবা করতে না পারার কষ্ট তার অন্তরে সর্বদা পীড়া দিত। এ জন্য তিনি দুধমাতা হালিমা সাদিয়াকে (রা.) নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। সন্তানের ওপর মায়ের যে হক তা কখনো আদায় হওয়ার মতো নয়। মায়ের বুকের এক ফোঁটা দুধের মূল্য সন্তানের গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও আদায় হবে না। সন্তানের জন্য মায়ের এক রাতের কষ্টের বিনিময় আদায় করা যাবে না কোনোভাবেই। মায়ের সঙ্গে নম্র আচরণ, যথাসাধ্য সেবা শুশ্রুষা এবং কায়মনোবাক্যে তার প্রতিদানের জন্য প্রভুর দরবারে দোয়া করলে মায়ের হক যৎকিঞ্চিত আদায় হতে পারে। মা সন্তানের জন্য জান্নাতের পথ করে দেন। যে সন্তান মায়ের সান্নিধ্য গ্রহণ করার পাশাপাশি মাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে তারাই সাফল্যের সন্ধান পেয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমার পালনকর্তা (কতিপয়) সিদ্ধান্ত দিয়েছেন (তা এই) যে, তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুব্যবহার করবে। যদি তাদের মধ্যে একজন কিংবা দু’জনই তোমার কাছে বৃদ্ধ বয়সে অবশ্যই পৌঁছে যায়, তাহলে (তাদের খিটখিটে ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে) তাদের তুমি উহ্ শব্দও বলবে না এবং তাদের ধমকও দেবে না। আর তাদের সঙ্গে তুমি সম্মানজনক কথা বলবে এবং তাদের জন্য দোয়ার মধ্য থেকে নম্রতার বাহু ঝুঁকিয়ে দাও। আর তাদের জন্য দোয়াস্বরূপ এ কথা বলবে, হে আমার পালনকর্তা, তাদের দু’জনের ওপর ঐরূপ দয়া কর, যেরূপ তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছিলেন (সুরা বনি ইসরাইল, ২৩-২৪ আয়াত)। ওই আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ৫টি নির্দেশ দিয়েছেন। ১. তাঁর ইবাদতের পরেই পিতা-মাতার সঙ্গে সুব্যবহার করা। ২. পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ বয়সে পেলে তাদের খিটখিটে মেজাজের কারণে বিরক্ত হয়ে তাদের ‘উহ্’ শব্দও না বলা। ৩. তাদের ধমক না দেয়া। ৪. তাদের মানসম্মান রেখে কথা বলা এবং শক্তির গরম না দেখানো। ৫. তাদের প্রতি দয়া করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। সন্তানের লালন-পালন ও উত্তম চরিত্র গঠনে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তার কোলই সন্তানের প্রথম পাঠশালা। মায়ের কাছ থেকেই সন্তান গ্রহণ করে জীবনের প্রথম পাঠ। তার ভাষায়ই ফোটে প্রথম কথা। মায়ের আচরণ থেকেই সে শিখে জীবনযাপনের পথ ও পাথেয়। শৈশব-কৈশোরে সন্তানের মধ্যে যে স্বভাব-চরিত্র গড়ে ওঠে, তা-ই তার জীবনের ভিত্তি এবং মৌলিক দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। সন্তানকে মায়ের কোলে থাকতেই সঠিক শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে না তুললে, আদব-কায়দা না শেখালে পরে কোনো ব্যবস্থাই কাক্সিক্ষত ফলদায়ক হয় না। বিখ্যাত সাহাবি ইবনে মাসউদ বলেন, একবার আমি হজরত নবী করীমকে (সা.) জিজ্ঞেস করলাম, কোন কাজটা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, সঠিক সময়ে নামাজ পড়া। আমি বললাম, তারপর? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার। আমি বললাম, তারপর? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে সংগ্রাম (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)। সাহাবি আবু উমামাহ (রা.) বলেন, একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) সন্তানের ওপর পিতা-মাতার অধিকার কী? তিনি (সা.) বললেন, তারা দু’জন তোমার জান্নাত অথবা তোমার জাহান্নাম (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের আদর্শ মোতাবেক মায়ের মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
পিতা মাতা : দায়িত্ব ও কর্তব্য : কোরান মাজিদের নির্দেশনা
কোরান মাজিদ আমাদেরকে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুবিস্তার ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। কোরান মাজিদ যদিও সকলের সাথে সদয় ও সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা প্রদান করে, তা পিতামাতার সাথে আমাদের সম্পর্ক বর্ণনার ক্ষেত্রে একটি খুব স্বতন্ত্র পরিভাষা ব্যবহার করে। তা আমাদেরকে পিতামাতার সাথে ইহসানপূণ আচরণ করার নির্দেশ প্রদান করে। ইমাম রাগিব, যাকে আরবি ভাষার একজন সুপন্ডিত মনে করা হয়, এই শব্দটিকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করেন-
ইহসান হল সম্পর্কের এমন একটি পর্যায় যেখানে কোন ব্যক্তি তার ন্যায্য অধিকার থেকে কম নিয়ে এবং আরোপিত দায়িত্ব থেকেও অধিক প্রদান করে তুষ্ট হয়। এই ব্যাখ্যা থেকে পরিষ্কার হয় যে, কোরান মাজিদ আমাদেরকে পিতামাতার সাথে কেবল যোগ্য ও ন্যায্য আচরণই করতে বলে না, বরং তা আমাদেরকে নির্দেশ দেয়, পিতামাতা আমাদের সাথে যেমনটিই আচরণ করুক না কেন তাতে সন্তুষ্ট থাকতে। যুগপৎভাবে, তা আমাদেরকে তাদের প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ ভালবাসা, সম্মান ও আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার সাধ্যমত চেষ্টা করতেও আদেশ প্রদান করে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু কোরানের আয়াত তুলে ধরা হল:
১. আর স্মরণ কর, যখন আমি বনি ইসরাইলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতিম ও মিসকিনদের সাথে। (আল-বাকারা, ২:৮৩)
২. তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক কর না। আর সদ্ব্যবহার কর পিতামাতার সাথে....। (আন-নিসা, ৪:৩৬)
৩. বল, এসো, তোমাদের উপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরিক করবে না এবং মাতা-পিতার প্রতি ইহসান করবে ...। (আল-আনআম, ৬:১৫১)
৪. আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতামাতার সাথে সদাচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপণীত হয়, তবে তাদেরকে উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। (বনি ইসরাইল, ১৭:২৩)
উল্লেখ্য যে, এসব আয়াতে কোরান মাজিদ আমাদেরকে প্রথমে আল্লাহর ইবাদত করতে বলে এবং অব্যবহিত পরেই আমাদেরকে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের আদেশ প্রদান করে। যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইসলাম ধর্মে পিতামাতার মর্যাদার আপেক্ষিক গুরুত্ব তুলে ধরে। নিম্নলিখিত আয়াতও আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ তাআলার হকের পরেই পিতামাতার হক।
আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতামাতার শুকরিয়া আদায় কর।... (লোকমান, ৩১:১৪)
বস্ত্তত, এটি আমাদের দীনের সৌন্দর্য ও অনুগ্রহ যে, তা মুসলিম সমাজে পিতামাতাকে এমন একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দান করেছে। আমাদেরকে একথা স্মরণ রাখতে ও উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলাই পিতামাতাকে এমন মর্যাদা প্রদান করেছেন। অতএব, আমাদের কর্তব্য হল আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করা এবং পিতামাতার প্রতি ইহসানের আচরণ করা। যদি আমরা তা করতে ব্যর্থ হই তবে অল্লাহ তাআলার আদেশ অমান্য করার কারণে আমরা কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হব। নিম্নে কোরান মাজিদের আরও কিছু সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা তুলে ধরা হল:
পিতামাতার মঙ্গল কামনা : আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতামাতার সাথে সদাচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপণীত হয়, তবে তাদেরকে উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। ( বনি ইসরাইল, ১৭: ২৩-২৪ )
অন্যান্য আয়াতের মত এখানেও কোরান মাজিদ আমাদেরকে প্রথমত, পিতামাতার সাথে ইহসানপূণ আচরণ করার ব্যাপারে সাধারণ নির্দেশনা প্রদান করে। অত:পর তা আমাদেরকে কিছু বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করে। তা বলে, যখন আমাদের পিতামাতা বার্ধক্যে উপণীত হয় তখন তাদের প্রতি আমাদের এতই সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে যে, তাদের প্রতি এমনকি উফ’ শব্দ পর্যন্ত বলা যাবে না। উল্লেখ্য যে, পিতামাতা তাদের বৃদ্ধ বয়সে অর্থনৈতিক ও শারিরীক প্রয়োজনে স্বভাবতই তাদের সন্তান সন্ততির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সাধারণত অধিক আবেগপ্রবণ ও মুখাপেক্ষী থাকে। কোরান মাজিদ আমাদেরকে বলে যে, যখন আমাদের পিতামাতা বয়সের এই পর্যায়ে উপণীত হবেন তখন তাদের প্রতি আমাদের এতই সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে যে, তাদের সামনে বিরক্তিসূচক একটি সাধারণ শব্দও উচ্চারণ করা যাবে না। হাসান ইবনে আলি (রা.) বলেন, এটি পিতামাতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের সর্বনিম্ন পর্যায়। এর নিচেও যদি কোন স্তর থাকত, তবে আল্লাহ তাআলা তা-ই উল্লেখ করতেন। দ্বিতীয়ত, পাশাপাশি কোরান মাজিদ আমাদেরকে নির্দেশ দেয়, তাদের সাথে সম্মান ও মর্যাদার সাথে কথা বলতে। তৃতীয়ত, তা আমাদেরকে তাদের সাথে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও বিনয়ের সাথে আচরণ করতে বলে। পরিশেষে, আমাদের দোয়ার মধ্যে তাদেরকে স্মরণ করতে হবে।
অমুসলিম পিতামাতার প্রতিও ইহসানপূর্ণ আচরণ : আর আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার সাথে সদাচারণ করতে, তবে যদি তারা প্রচেষ্টা চালায় আমার সাথে এমন কিছুকে শরিক করাতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না। আমার দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন... ( আল-আনকাবুত, ২৯:৮)
আর যদি তারা আমার সাথে শিরক করাতে জোর প্রচেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে।...(লোকমান, ৩১:১৫)
যে ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করে সে কখনো অন্যকে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করতে আদেশ করতে পারে না। এই আয়াতে কোরান মাজিদ এমন পিতামাতার কথাই বলে এবং আমাদেরকে আদেশ দেয় যে, যদি পিতামাতা আমাদেরকে আল্লাহর সাথে শরিক করতে চাপ প্রয়োগ করে তবে তা মানা যাবে না। তবে তখনো তাদের সাথে ইহসানের সাথে আচরণ করতে হবে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, পিতামাতা যদি ছেলেমেয়েকে কোন পাপ কাজ করার আদেশ প্রদান করে তবে তা পালন করা যাবে না, তবে তাদের প্রতি ভালবাসা অব্যাহত রাখতে হবে এবং দয়া ও সহানুভূতির সাথে আচরণ করতে হবে।
পিতামাতার জন্যে ব্যয় করা : তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য।.. (আল-বাকারা, ২:২১৫)
এই আয়াতটি পিতামাতার মর্যাদার কথা আমাদেরকে পূণর্বার স্মরণ করিয়ে দেয়। তা বলে, আমরা যা কিছুই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে খরচ করি না কেন, পরিবার কিংবা সমাজের অন্যান্য লোকের পূর্বে প্রথমে পিতামাতার জন্যেই আমাদেরকে খরচ করতে হবে। অতএব, যদি কেউ তার পরিবারের সদস্যদের উপর ব্যয় করে কিংবা সমাজের কোন মহৎ কাজে ব্যয় করে, কিন্তু পিতামাতার অধিকার সম্পর্কে বেখবর থাকে, সে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ লঙ্ঘন করে। আমাদের প্রথম কর্তব্য হল, পিতামাতার প্রয়োজনের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং তাদের সাথে ইহসানের আচরণ করা, এমনকি অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রেও।
পিতামাতার জন্যে অর্থ রেখে যাওয়া : তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোন সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা মাতা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ন্যায় ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকীদের দায়িত্ব। (আল-বাকারা, ২:১৮০)
ইসলামই একমাত্র দিন যা এমন এক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যাতে কেবল অধঃস্তনরাই উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয় না; বরং উর্ধ্বতন পরম্পরাইও উত্তরাধিকার বন্টিত হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্য সকল সমাজ ব্যবস্থায় কেবল অধ্বঃস্তনদের জন্যেই উত্তরাধিকারের আইন প্রচলিত আছে। এই আয়াত আমাদেরকে বলে যে, আমাদের প্রথম কর্তব্য আমাদের পিতামাতার প্রতি। এবং এমনকি উইল করে যাওয়ার সময়ও।
পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা : আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতামাতার শুকরিয়া আদায় কর।... (লোকমান, ৩১:১৪)
আল্লাহ তাআলার নিয়ামতরাজিকে যেমন কেউ গণনা করে শেষ করতে পারে না, তেমনিভাবে পিতামাতার অনুগ্রহকেও কেউ হিসেব করে শেষ করতে পারবে না। কোরান মাজিদ তাই আমাদেরকে বলে, প্রথমত, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এবং অত:পর পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ এই নয় যে, কেবল ধন্যবাদ (Thank you) বলবে। বরং, তার অর্থ আমাদের এমন এক জীবনাচরণ পদ্ধতি ও মনোভঙ্গি যা আল্লাহ তাআলার প্রতি ও অতঃপর আমাদের পিতামাতার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধকে প্রতিফলিত করে।
পিতামাতার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : অতঃপর সুলাইমান তার কথায় মুচকি এবং বলল, হে আমার রব, তুমি আমার প্রতি ও আমার পিতামাতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ তার জন্য আমাকে তোমার শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দাও। (আন-নামাল, ২৭:১৯)
আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রদি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভ ধারণ ও দুধ পান ছাড়ানোর সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং চল্লিশ বছরে উপণীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, আমাকে সামর্থ দাও, তুমি আমার উপর ও আমার পিতামাতার উপর যে নিআমত দান করেছ, তোমার সে নিআমতের যেন আমি শুকর আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। এরাই যাদের উৎকৃষ্ট আমলগুলো আমি কবুল করি এবং তাদের মন্দ কাজগুলো আমি ক্ষমা করে দেই। ... (আল-আহক্বাফ, ৪৬: ১৫- ১৬)
এই আয়াতগুলি সেসব ঈমানদারের মনোভাবকে ব্যক্ত করে যাদের মন্দকর্মসমূহ আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের একটি গুণ হল যে, তারা তাদের উপর আল্লাহ তাআলার নিয়ামতসমূহের জন্যে শুকরিয়া আদায় করে এবং যুগপৎভাবে, তারা তাদের পিতামাতার উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহসমূহের জন্যেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
পিতামাতার জন্যে প্রার্থনা : আর তাদের উভয়ের উপর দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমাদের রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমার প্রতি লালন পালন করেছেন’। (বনি ইসরাইল, ১৭:২৪)
আমরা আমাদের পিতামাতার প্রতি যতই দয়ালু ও কৃতজ্ঞ হই না কেন, আমরা তাদের প্রয়োজন ও অধিকার অনুসারে সবকিছু প্রদান করতে সমর্থ নই। এজন্যে কোরান মাজিদ আমাদেরকে বলে, পিতামাতার জন্যে আমাদের দোয়াও করতে হবে। যাতে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর দয়া করেন এবং সেসব বিষয় তাদের জন্য সরবরাহ করেন যা তাদেরকে আমরা দিতে অক্ষম।
মায়ের বিশেষ মর্যাদা : আমি মানুষকে তার পিতামাতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার পিতামাতার শুকরিয়া আদায় কর। ... (লোকমান, ৩১:১৪)
আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রশি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভ ধারণ ও দুধ পান ছাড়ানোর সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং চলিলশ বছরে উপণীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, আমাকে সামর্থ দাও, তুমি আমার উপর ও আমার পিতামাতার উপর যে নিআমত দান করেছ, তোমার সে নিআমতের যেন আমি শুকর আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। (আল-আহক্বাফ, ৪৬: ১৫)
এই আয়াতগুলো মায়ের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে।
মায়ের জন্যে নূহ (আ.)-এর দোয়া : হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতামাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে এবং মুমিন নারী পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি জালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না। (নূহ,৭১:২৮)
পিতামাতার জন্যে ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া : হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার পিতামাতাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। (ইবরাহিম ১৪:৪১)
ইয়াহইয়া (আ.) ও তাঁর পিতামাতা : হে ইয়াহইয়া! তুমি কিতাবটিকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর। আমি তাকে শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করেছি। আর আমার পক্ষ থেকে তাকে স্নেহ মমতা ও পবিত্রতা দান করেছি এবং সে মুত্তাকী ছিল। আর সে ছিল তার পিতামাতার সাথে সদাচারী, আর ছিল না অহংকারী, অবাধ্য। (মারাইয়াম, ১৯:১২-১৪)
ঈসা (আ.) ও তাঁর মা : শিশুটি বলল, আমি তো আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবি বানিয়েছেন। আর যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও জাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন। আর আমাকে মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে অহংকারী, অবাধ্য করেন নি। (মারাইয়াম, ১৯:৩০-৩২)
মুসলমান হিসেবে আমরা আল্লাহ তাআলার সকল নবি-রাসূলের উপর বিশ্বাস রাখি। কোরান মাজিদ আমাদেরকে বলে যে, অন্যান্য নবিগণও তাদের পিতা মাতার প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদেরকে দোয়ার মধ্যে স্মরন করতেন। বলা বাহুল্য, পিতামাতার যথাযথ অধিকার প্রদান ও তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নবিদের আমলের অনুসরণ করাও আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য।
পিতা মাতা : দায়িত্ব ও কর্তব্য : হাদিসের নির্দেশনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসসমূহ পিতামাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আরও অধিক সবিস্তার বিবরণ প্রদান করে। তা পিতামাতার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে পুরষ্কার এবং তাদের অবাধ্য হলে শাস্তির বর্ণনাও প্রদান করে। নিচে কিছু সংশ্লিষ্ট হাদিস পেশ করা হল:
পিতামাতার আনুগত্যের গুরুত্ব : হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম.কে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, তা হল- আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, তাদের সাথে অসদাচারণ করা কিংবা তাদের আঘাত দেওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (বুখারি)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোন আমল বা কাজ আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়? তিনি উত্তরে বলেন, সময়মত নামাজ আদায় করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরপরে কি? তিনি উত্তর করলেন, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অত:পর কি? তিনি উত্তর করলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারি, মুসলিম)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আছ (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করল এবং বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বায়আত হতে এসেছি। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন, তার পিতামাতা বেঁচে আছে কিনা। লোকটি উত্তর করল, হ্যঁা, উভয়েই বেঁচে আছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সেবা কর। (বুখারি, মুসলিম)
এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে ওলামায়ে কেরাম বলেন, যদি ফরজে আইন না হয় তবে পিতামাতার অনুমতি ব্যতিত জিহাদ কিংবা দীন শিক্ষা করার জন্য নিজ শহরের বাইরে যাওয়া যাবে না। নিম্নলিখিত হাদিসটিও একই বিষয় ব্যক্ত করে:
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জিহাদের উদ্দেশ্যে ইয়ামেন থেকে মদীনায় হিজরত করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়ামেনে তার কোন আত্মীয়-স্বজন আছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, সেখানে তার পিতামাতা রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, সে তার পিতামাতার অনুমতি নিয়ে এসেছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, না। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও। হিজরতের জন্যে তাদের অনুমতি নিয়ে আস। যদি তারা তোমাকে অনুমতি দেয় তবে জিহাদে গিয়ে শরিক হও। যদি তারা তোমাকে অনুমতি না দেয় তবে তাদের সাথে অবস্থান কর এবং ভালভাবে তাদের সেবা যত্ন কর। (আবু দাউদ, আহমদ)
হিজরত ও জিহাদ আল্লাহ তাআলার কাছে দুটি প্রিয়তম বস্ত্ত। বস্ত্তত, যদি কারও পিতামাতা অসুস্থ কিংবা বৃদ্ধ হয়ে যায় তবে তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন পিতামাতার সেবা করাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এবং এর ফলে হিজরত ও জিহাদকারীদের সমতুল্য সওয়াব সে প্রাপ্ত হবে। এসব হাদিস থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যদি কেউ পিতা মাতার বৃদ্ধ বয়সে বা তাদের অসুস্থতার সময় কোন জাগতিক ইচ্ছা কিংবা প্রয়োজনে তাদের উপেক্ষা বা অবহেলা করে তবে সে গুরুতর পাপের অপরাধী বিবেচিত হবে।
অন্যদের পিতামাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একটি বড় পাপ হল, কোন ব্যক্তির, তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়া। তারা জানতে চাইলেন, কেউ কি তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়? তিনি উত্তর করলেন, কোন ব্যক্তি অন্যের পিতাকে অভিশাপ দেয়। ফলে সেও তার পিতাকে অভিশাপ দেয় এবং সে অন্যের মাকে অভিশাপ দেয়, তখন সেও তার মাকে অভিশাপ দেয়। (বুখারি, মুসলিম)
এটি ইসলামের সৌন্দর্য ও মহত্ত যে, তা কেবল নিজের পিতা মাতাকেই ভালবাসতে ও সম্মান জানাতে শিক্ষা দেয় না, বরং অন্যদের পিতামাতার সাথেও অনুরূপ আচরণ করতে শিক্ষা দেয়।
পিতামাতার অধিকারের তাৎপর্য : হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করে, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সন্তানের উপর তাদের পিতামাতার কি অধিকার? তিনি উত্তর দিলেন, তারা তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ)
কোরান মাজিদ বারংবার ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ তাআলার হকের পরেই পিতামাতার হক। যদি আমরা তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি তবে আল্লাহ তাআলার আদেশেরই আনুগত্য করি। যদি আমরা তাদের অসম্মান করি তবে আমরা আল্লাহর আদেশকেই অমান্য করি। অতঃপর তার ফলে পরিণামস্বরূপ জাহান্নামে যেতে পারি।
বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া : হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করে, কে আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? আর তিনি উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি চতুর্থবারের মত জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, তোমার পিতা। (বুখারি, মুসলিম)
ইসলামে পিতামাতার মর্যাদা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেই। বস্ত্তত, মায়ের মর্যাদা পিতার মর্যাদার চেয়ে তিনগুণ বেশি। এই হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, তা তিনটি বিশেষ কষ্টের কারণেই যা মাতা তার সন্তানের জন্যে স্বীকার করে থাকেন। যথা: গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তানকে দুগ্ধপান করানোর সময়কাল।
বর্ণিত আছে যে, একদা সাহাবী.জারীহকে তার মা ডাকেন, যখন তিনি নামাজরত ছিলেন। কিন্তু, তিনি নামাজ অব্যাহত রাখেন। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পারলেন, তিনি বললেন, যদি জারীহ জানত যে, মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া আল্লাহ তাআলার কাছে নামাজ পড়া থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। (ফতহুল বারী, শরহুল বুখারি)
এই হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, এ থেকে কেবল নফল নামাজই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে যদি পিতামাতা তাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে ডাকেন তবে ফরজ নামাজরত থাকলেও তা ভেঙে তাদের ডাকে সাড়া দিতে হবে।
বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মাতাকে হারাম শরীফে নিয়ে আসে। সে তাকে তার কাঁধে নিয়ে কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করতে থাকে। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এখন আমার মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করেছি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তর দিলেন, তুমি তোমার মায়ের একটি শ্বাসে-প্রশ্বাসের হকও আদায় কর নি। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খন্ড)
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে ইসলামের জন্যে জিহাদে শরিক অনুমতি চাইল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার মা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি উত্তরে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ বললেন, ফিরে যাও এবং তোমার মায়ের কাছে থাক। কেননা, বেহেশত তার পায়ের নিচে। (আহমদ, বায়হাকি, নাসায়ি)
এই হাদিসটি ছেলেমেয়েকে পিতামাতার কাছে বিশেষত মায়ের নিকটে থাকার আদেশ প্রদান করে। এটি তাদেরকে আরও বলে যে, তারা যেন তাদের সাধ্য অনুসারে মায়ের সেবা করে। কেননা, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। ইসলামের এই বুনিয়াদি শিক্ষা মুসলিম সমাজে মাতাগণকে একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দান করেছে। পরিবারের সকল সদস্যের কাছে মা তার জীবনের শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত ভালবাসা ও সম্মানের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। পরিশেষে, পশ্চিমা সমাজও মাতাদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। তারা বছরের একটি দিনকে মা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করে তা প্রকাশ করে থাকে। সকল ছেলেমেয়ে একত্রে সেদিন আগমন করে এবং তাদের মায়ের প্রতি তাদের ভালবাসা ও মমতা প্রদর্শন করে। দুর্ভাগ্যবশত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মায়েরা তাদের বৃদ্ধ বয়সে কোন না কোন নার্সিং হোমে জীবন পার করে। পক্ষান্তরে, একজন মুসলিমের জীবনে প্রতিটি দিনই একেকটি মাতৃদিবস এবং তিনি কখনো তার বার্ধক্যকাল নার্সিংহোমে যাপন করেন না।
মায়ের ভগ্নির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে আগমন করল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি পাপ করেছি। আমার ক্ষমা পাওয়ার কোন পথ আছে কি? তিনি জানতে চাইলেন, তাঁর মাতা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি বলল, না’। তিনি জানতে চাইলেন, তার মাতার ভগ্নি জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তাকে ভালভাবে সেবা যত্ন কর। (তিরমিযি)
এই হাদিসটি আমাদেরকে দুটি বুনিয়াদি বিষয় শিক্ষা দেয়। প্রথমত: যদি কোন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে বসে এবং এর দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে, সে তার মায়ের সেবা করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ফিরে পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, যদি তার মাতা মৃত্যুবরণ করে তবে সে তার মায়ের ভগ্নির সেবার মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ফিরে পেতে পারে।
বারা ইবনে আযিব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মায়ের ভগ্নি মায়ের সমতুল্য। (তিরমিযি)
একজন অমুসলিম মায়ের প্রতিও দয়া প্রদর্শন : আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, তার মাতা অমুসলিম অবস্থায় তাকে দেখতে মদীনায় আসেন। তিনি রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা অমুসলিম। কিন্তু তিনি আমার কাছে কিছু পেতে আশা করছেন। আমি কি তাকে সন্তুষ্ট করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (বুখারি, মুসলিম)
আসমা ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহিয়সী স্ত্রী আয়েশা (রা.) এর বৈমাত্রেয় বড় বোন। আবু বকর (রা.) মুসলমান হওয়ার পুর্বে তাকে( তার মাকে) তালাক দিয়েছিলেন। সে ইসলাম গ্রহন করেনি এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অমুসলিমরা যখন মদীনায় আসার অনুমতি পায়, সে তখন তার মেয়েকে দেখতে মদীনায় আসে। যখন আসমা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তার মায়ের সাথে কেমন আচরণ করবেন? তিনি তার মায়ের প্রতি সদয় ও বিবেচক হতে নির্দেশ দিলেন, সে একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও।
পিতার মর্যাদা : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত। (তিরমিযি)
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমার এক স্ত্রী ছিল যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু, আমার পিতা ওমর তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বললেন তাকে তালাক দিতে। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখান করি। ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলেন এবং এ বিষয়টি তাকে অবহিত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন এবং তাকে তালাক দিয়ে দিতে বললেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)
(বর্ণিত আছে, এরপর তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন।)
উল্লেখ্য যে, ইসলামে বিয়ে ও তালাক প্রদানের অধিকারী কেবল স্বামী। (আরও বিস্তারিত জানার জন্যে এই বইয়ের ৩য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) এমনকি যদি পিতামাতা তাদের ছেলের স্ত্রীদের পছন্দ নাও করেন তবুও তারা ছেলের বউকে তালাক দিতে বাধ্য করতে পারেন না। তবে যেহেতু, ওমর (রা.) ছিলেন একজন বড় ন্যায়বান সাহাবী, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কে তার পিতার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছেন।
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তিই তার পিতার হক আদায় করতে পারে না, তবে যদি সে তাকে দাস অবস্থায় পায় এবং (তাকে কিনে) আজাদ করে দেয়। (মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একটি বড় পূণ্য কাজ হল পিতার বন্ধুদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা। (মুসলিম)
অন্যত্র তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন প্রকারের দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। পিতার দোয়া (তার সন্তানের জন্যে), (আল্লাহর পথের) মুসাফিরের দোয়া ও মজলুমের দোয়া। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযি)
যদিও ইসলামে মায়ের মর্যাদা পিতার চেয়ে তিনগুণ বেশি, কিন্তু পিতার ভূমিকা ও মর্যাদাকে খাট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এই হাদিস পিতাকে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করে এবং বলে যে, সন্তানের জন্যে পিতার দোয়াকে আল্লাহ তাআলা ফিরিয়ে দেন না। অতএব, আমাদের উচিৎ হবে, সাধ্যমত পিতাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা।
মৃত্যুর পরে পিতামাতার অধিকার : আবু ওসাইদ সায়েদী (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ছিলাম। এমতাবস্থায় বনু সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! পিতামাতার মৃত্যুর পর আমার উপর কি তাদের কোন হক রয়েছে, যা আমাকে পালন করতে হবে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তাদের জন্যে দোয়া করবে। তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তাদের অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করবে। তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে যারা তাদের কারণে তোমার আত্মীয় হয়েছে এবং তাদের সাথী সঙ্গীদেরকেও সম্মান করবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
ইসলামে পিতামাতার অধিকার এতই স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ যে, তা কখনো শেষ হয় না, এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও। এই হাদিস আমাদের উপর তাদের মৃত্যু পরবর্তী কিছু অধিকারের কথা তুলে ধরে।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতামাতার প্রতি সর্বাধিক উত্তম আনুগত্য হল তাদের মৃতুর পর তাদের সঙ্গী সাথীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা।(মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) মক্কার পথে এক বেদুঈনের সাক্ষাত পেলেন। তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি অমুকের পুত্র অমুক? লোকটি উত্তর করল, হ্যাঁ। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাকে তার গাধাটি দিয়ে দিলেন এবং এতে আরোহন করতে বললেন। তিনি তাকে তার পাগড়িটিও দিয়ে দিলেন এবং তা মাথায় পরে নিতে বললেন। তাঁর কিছু সহচর বলল, আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন! সে তো কেবলই একজন বেদুঈন। আর বেদুঈনরা সামান্য বস্ত্ততেই তুষ্ট হয়ে থাকে। আপনি তাকে আপনার গাধা ও পাগড়ি দিয়ে দিলেন? অথচ, এ সবে আপনার নিজেরও প্রয়োজন রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) উত্তর দিলেন, তার পিতা ছিলেন আমার পিতার বন্ধু এবং আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, একটি বড় পূণ্যের কাজ হল, পিতার বন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে উত্তম আচরণ করা। (মুসলিম)
যদিও এ হাদিসে কেবল পিতার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেহেতু, ইসলামে মায়ের মর্যাদা পিতার মর্যাদার তিনগুণ, এ থেকে বুঝা যায়, মায়ের বন্ধ-বান্ধব এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথেও উত্তম আচরণ করা জরম্নরি।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, সাদ ইবনে আছ (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) একটি অঙ্গীকার করেছিলেন, যা তার পালন করা উচিৎ ছিল। অথচ তিনি তা করেন নি। উত্তরে তিনি বললে, তার পক্ষ থেকে তুমি তা পালন কর। (বুখারি, মুসলিম)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রায়ই এমনটি হয়ে থাকে যে, কোন ব্যক্তির পিতামাতার একজন কিংবা উভয়েই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সে তাদের জীবদ্দশায় যথাযথ সেবা যত্ন করতে পারে নি। এভাবে নিজেকে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন থেকে বঞ্চিত করে। অতঃপর সে তার দোয়ার মধ্যে তাদেরকে স্মরণ করে এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তাআলা তার নাম মাতাপিতার নাফরমানদের তালিকা থেক পরিবর্তন করে অনুগতশীলদের তালিকাভুক্ত করে নেন। (বায়হাকি)
এই হাদিসটি তাদের জন্যে শুভ সংবাদ বহন করে যারা পিতামাতার উভয়কে কিংবা তাদের একজনকে হারিয়েছে। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, সে তার পিতামাতার প্রতি যথাযথ হক আদায় করেছে। অতএব, আমাদের উচিৎ হবে তাদের জীবদ্দশায় সাধ্যমত তাদের হক আদায় করার চেষ্টা করা এবং মৃত্যুর পরে তাদেরকে আমাদের দোয়ায় স্মরণ করা। তা কেবল তাদের জন্যেই উপকারী হবে না, বরং তাদের জীবদ্দশায় তাদের সেবা যত্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ত্রুটি ও দুর্বলতাকেও মোচন করে দেবে।
পিতামাতার আনুগত্যের পুরষ্কার : আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতামাতার হকের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার অনুগত হয়ে যে ব্যক্তি ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, প্রভাতে তার জন্যে জান্নাতের দুটি দরজা খুলে যায়। আর যদি কেবল একজন বেচে থাকেন তখন তার জন্যে শুধু একটি দরজা খুলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পিতা-মাতার হকের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হয় তার জন্যে জাহান্নামের দুটি দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর যদি কেবল একজন বেঁচে থাকেন তবে শুধু একটি দরজাই খুলে দেওয়া হয়। এক ব্যক্তি জানতে চাইল, যদি পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়, তবুও কি এরূপ হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, যদিও পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যদিও পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যদিও পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। (বায়হাকি)
যাবের (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে আল্লাহ তাআলা তার মৃত্যুকে সহজ করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর তা হল, দুর্বলদের প্রতি দয়া, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও দাস-দাসীদের (চাকর চাকরাণীদের) প্রতি ভাল আচরণ। (বায়হাকি)
ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দোয়া ব্যতিত অন্য কিছুই ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতামাতার প্রতি সদাচার ব্যতিত অন্য কিছুই আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোন ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাজাহ)
জীবন প্রলম্বিত হওয়া সম্পর্কে বিজ্ঞজনেরা বলেন, এ থেকে উদ্দেশ্য জীবনে সৎকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বছরের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। যে ব্যক্তি পিতামাতার অনুগত সে জীবনে ভাল কাজ করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ লাভ করবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পিতামাতার অবাধ্য হবে সে বিভিন্ন রোগ, শোক, দুঃখ বেদনা ও পেরেশানিতে আক্রান্ত হবে এবং জীবনে ভাল কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতামাতার আনুগত্য কর এবং তাদের সাথে সদয় ব্যবহার কর। কেননা, যদি তুমি তেমনটি কর তবে তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার আনুগত্য করবে এবং তোমার সাথে সদয় ব্যবহার করবে। (তাবরানি)
একটি গল্প প্রচলিত আছে, তা সত্য হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, তবে তা একটি ভাল বার্তা বহন করে। কথিত আছে, এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ পিতার সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাই সে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন সে তার পিতাকে কাপড়ে মুড়িয়ে একটি কুপের কাছে নিয়ে গেল। যখনই সে তাকে কুপে নিক্ষেপ করার উপক্রম হল, তখন তার পিতা তাকে বলল, তার একটি শেষ ইচ্ছা রয়েছে এবং সে যেন তা পূর্ণ করে। ছেলে তাকে তার শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, তার শেষ ইচ্ছা হল, সে যেন তাকে এই কুপে নিক্ষেপ না করে অন্য কোন কুপে নিক্ষেপ করে। ছেলে তার এ ইচ্ছার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে পিতা বলল, সে তার পিতাকে ইতোপূর্বে এই কুপটিতে নিক্ষেপ করেছিল। ছেলে এ থেকে একটি বার্তা পেল এবং তৎক্ষণাৎ পিতাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আর আমৃত্যু ভালভাবে তার সেবা যত্ন করল।
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম এবং স্বপ্নে দেখতে পেলাম যে, আমি বেহেস্তে প্রবেশ করেছি। তাতে কাউকে কোরান তেলাওয়াত করতে শুনলাম এবং আমি জানতে চাইলাম, আল্লাহর কোন বান্দা বেহেস্তের মধ্যে কোরান তেলাওয়াত করছে? আমাকে বলা হল, তিনি হচ্ছেন হারিছা ইবনে নুমান। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হারিছা ইবনে নুমান তার মায়ের খুব অনুগত ছিল এবং তার খুব সেবা যত্ন করত। (বায়হাকি)
পিতামাতার অবাধ্যতার পরিণাম : আবু বারকাহ নুফাই ইবনে হারিছ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাকে বলব, কবীরা গুনাহ কি কি? তিনি একথাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। আমি বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বালিশে হেলান দেয়া ছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, এবং মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। তিনি বাক্যটি এত বেশি পরিমাণে পুনরাবৃত্তি করলেন যে, আমরা আশা করছিলাম, তিনি যদি থেমে যেতেন। (বুখারি)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামক কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া ও তাদের কষ্ট দেওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (বুখারি)
উপরোক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবীরা গুনাহর বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ক্রমধারা অবলম্বন করেছেন তা লক্ষ্যণীয়। পিতামাতার সাথে নাফরমানী করার অপরাধ গুরুত্বের বিচারে আল্লাহর সাথে শিরক করার পরে এবং তা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া থেকেও অধিক গুরুতর।
মুগীরা ইবনে শুবা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মাদের অবাধ্য হতে, কৃপণতা, মিথ্যা অপবাদ ও কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া থেকে। আর তিনি তোমাদেরকে বারণ করেছেন, অবান্তর কথাবার্তা, অত্যধিক জিজ্ঞাসা ও অপচয় থেকে। (বুখারি, মুসলিম)
পিতামাতার অবাধ্যতার শাস্তি : আবু বারকাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, পিতামাতার নাফরমানী ব্যতিত। আর তিনি পিতামাতার অবাধ্যতার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। (বায়হাকি)
তিনটি বিশেষ ঘটনা : যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করেন এবং তার পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমার পিতা আমার সম্পদ নিয়ে যেতে চান। তিনি বললেন, তোমার পিতাকে নিয়ে আস। এমন সময়ই জিবরাইল আগমন করলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, তার পিতা আসলে আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, ঐ বাক্যগুলো কি, যেগুলো সে মনে মনে বলেছে এবং স্বয়ং তার কানও শুনতে পায় নি। যখন লোকটি তার পিতাকে নিয়ে হাজির হল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যাপার কি, আপনার পুত্র আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল কেন? আপনি কি তার আসবাবপত্র ছিনিয়ে নিতে চান? পিতা বলল, আপনি তাকে এ প্রশ্ন করুন, আমি তার ফুফু, খালা ও নিজের জীবন রক্ষার প্রয়োজন ব্যতিত তা কোথায় ব্যয় করি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যাস! অভিযোগ ব্যাখ্যার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। এরপর তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ বাক্যগুলো কি, যেগুলো এখন পর্যন্ত স্বয়ং আপনার কানও শোনেনি? ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রত্যেক ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে দিন। (যে কথা কেউ শুনেনি তা আপনার জানা হয়ে গেছে। এটা একটা মুজিজা। অতঃপর সে বলল, এটা ঠিক যে, আমি মনে মনে কয়েক লাইন কবিতা বলেছিলাম, যেগুলো আমার কানও শুনে নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কবিতাগুলো আমাকে শুনান। তখন সে নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করল, আমি শৈশবে তোমাকে খাবারের ব্যবস্থা করেছি এবং যৌবনেও তোমার দায়িত্ব বহন করেছি। তোমার যাবতীয় খাওয়া-পরা আমারই উপার্জন থেকে ছিল। কোন রাতে যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ, তখন আমি সারা রাত জেগে কাটিয়েছি। যেন তোমার রোগ আমাকেই স্পর্শ করেছে, তোমাকে নয়। ফলে সারা রাত আমি ক্রন্দন করেছি। আমার অন্তর তোমার মৃত্যুর ভয়ে ভীত হত; অথচ আমি জানতাম যে, মৃত্যুর জন্য দিন নির্দিষ্ট রয়েছে- আগে পিছে হতে পারবে না। অতঃপর যখন তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছ এবং আমার আকাঙ্খিত বয়সের সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেছ, তখন তুমি কঠোরতা ও রুঢ় ভাষাকে আমার প্রতিদান করে দিয়েছ, যদি তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ ও কৃপা না করতে, আফসোস! যদি তোমার দ্বারা আমার পিতৃত্বের হক আদায় না হয়, তবে কমপক্ষে ততটুকুই করতে যতটুকু একজন ভদ্র প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীর সাথে করে থাকে। তুমি কমপক্ষে আমাকে প্রতিবেশীর হক তো দিতে এবং আমার সম্পদে আমার সাথে কৃপণতা না করতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতাগুলো শুনার পর ছেলের জামার কলার চেপে ধরলেন এবং বললেন, যাও, তুমি ও তোমার সম্পদ সবই তোমার পিতার। (তাফসীরে কুরতুবী, ৬:২৪)
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন: একদা তিন ব্যক্তি পথিমধ্যে বৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ায় একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল। একটি পাথর গড়িয়ে এসে গুহার মুখকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিলে তিন ব্যক্তিই গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেল। তারা পরস্পর পরস্পরকে বলল, চল, আমরা আমাদের এমন কোন পূণ্য কাজের কথা স্মরণ করি যা আমরা একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য করেছি এবং তার উসীলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তিনি গর্ত থেকে পাথরটি সরিয়ে দেন। তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার বৃদ্ধ ও দুর্বল পিতামাতা রয়েছে এবং ছোট ছেলেমেয়েও আছে। যাদের জন্য আমি ভেড়া পালন করি। যখন আমি রাতের বেলা ঘরে ফিরি প্রথমে পিতামাতাকেই আমি দুগ্ধ পান করতে দেই এবং অতঃপর ছেলেমেয়েকে দেই। একদিন আমি রাতের বেলা দেরীতে ঘরে ফিরে পিতামাতা উভয়কেই নিদ্রিত অবস্থায় পেলাম। আমি অন্যদিনের মত দুধ নিয়ে তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের নিকটে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তাদেরকে ঘুম থেকে জাগানো পছন্দ করলাম না এবং এও চাইলাম না যে, প্রথমে আমার ছেলেমেয়েকে দুধ পান করতে দেব। যদিও আমার ছেলেমেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় কান্নাকাটি করছিল। আমি ভোর হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজটি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি তবে আমাদের উপর থেকে পাথরটিকে সরিয়ে দিন। এতে আল্লাহ তাআলা গর্তের উপর থেকে পাথরটিকে কিছুটা সরিয়ে দিলেন।
দ্বিতীয় লোকটি বলল, সে তার এক চাচাত বোনকে ভালবাসত এবং সে তার সাথে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যখন সে (চাচাত বোন) তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিল সে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকল। অতঃপর সে দোয়া করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজটি কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যে করে থাকি তবে গর্তের উপর থেকে পাথরটিকে সরিয়ে দিন। আল্লাহ তাআলা তার দুআ কবুল করেন এবং পাথরটি গর্তের মুখ থেকে আরও কিছুটা সরে গেল। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, সে এক লোকের সাথে একটি অংশীদারী কারবার করত। লোকটি অন্যত্র চলে গেলে সে একাই তা দেখাশুনা করতে থাকে এবং তার অংশীদারের অংশের হিসাব রাখত। যখন অংশীদার ফিরে এল সে তার অংশ লাভসহ বুঝিয়ে দিল। অতঃপর সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজ কেবলমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, আপনি এর উসীলায় গর্তের মুখ থেকে পাথরটি সরিয়ে দিন। আল্লাহ তাআলা তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং গর্তের মুখ সস্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হয়ে গেল। আর তারা তা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হলো। (বুখারি, মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই (রা.) বর্ণনা করেন সাহাবী আলকামা নামাজ রোজার ক্ষেত্রে খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন। যখন তার মৃত্যু নিকটবর্তী হল, লোকেরা তাকে কালেমার তালকীন করলেন। কিন্তু, তিনি তা পড়তে সমর্থ হলেন না। এই অবস্থা তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানোর জন্যে লোক পাঠালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পিতামাতা বেঁচে আছেন কিনা। তাঁকে জানানো হল, আলকামার মা বেঁচে আছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি অতি দ্রম্নত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে হাজির হলেন। তিনি আলকামা সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, সে একজন দীনদার লোক। তবে তার উপর স্ত্রীকে বেশি প্রাধান্য দেয় এবং তাকে অমান্য করে। তাই তিনি তার উপর অসন্তুষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিতে বললেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হলেন না। তিনি তখন বেলাল (রা.)-কে কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত আগুনে আলকামাকে নিক্ষেপ করতে বললেন। মা একথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বাস্তবিকই আলকামাকে আগুনে পোড়াতে ইচ্ছুক কিনা? তিনি তখন বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলার শাস্তি এই শাস্তি থেকেও অনেক কঠিন। আল্লাহর কসম! আপনি যতক্ষণ আপনার ছেলের উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, তার না কোন নামাজ আল্লাহর কাছে কবুল হবে আর না কোন দান। আলকামার মা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আলকামাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আলকামার অবস্থা দেখার জন্যে কাউকে তার কাছে পাঠালেন। তখন সে এই সুসংবাদ নিয়ে ফিরে এল যে, আলকামা কালেমা পাঠ করে মৃত্যুবরণ করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তার জানাজায় গেলেন এবং বললেন, মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার মায়ের অবাধ্য হবে কিংবা তাকে অসন্তুষ্ট করবে, তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেস্তা ও সকল মানুষের অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। আল্লাহ তাআলা তার কোন কাজ কিংবা নফল ইবাদত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে অনুশোচিত হবে, মায়ের যথাযথ পরিচর্যা ও সেবা করবে এবং তাকে সন্তুষ্ট করবে।’ (তাবরানি)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসারদের সম্বোধন করেছেন। কেননা, তখন তার আশেপাশে কেবল তারাই ছিলেন। অধিকন্তু, তিনি কেবল মায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, ঘটনাটি মায়ের সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কিত ছিল। যা হোক, এটি পরিষ্কার যে, এই নির্দেশনাটি সকল মুমিনের জন্যে এবং পিতামাতা উভয়ের সন্তুষ্টির কথা বলে, বিশেষতঃ মায়ের। আমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, আলকামা ছিলেন খুব ধার্মিপরায়ন ব্যক্তি লোক এবং তার নামাজ রোজার ব্যাপারে খুবই নিয়মানুবর্তী। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন সাহাবীও ছিলেন। এসব কিছুই মৃত্যুর সময় তাকে সাহায্য করতে পারে নি। তিনি মৃত্যুর সময় কালিমা শাহাদাত পাঠের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন কেবল তার মাকে অসন্তুষ্ট করার কারণে। আমাদের সেই হাদিসও স্মরণ রাখতে হবে যাতে এসেছে, যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, তার শেষ কথা হবে কালেমা, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ বলতে পারে না কখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে। অতএব, আমাদেরকে শীঘ্রই আমাদের মাতা পিতার, বিশেষ করে মায়ের সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে। অন্যথায় আমরাও মৃত্যুর সময় কালেমা পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব।
মা-বাবার মৃত্যুর পর সন্তানদের পালনীয়-করণীয় আমল
বেশী বেশী দোয়া করা : মা-বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশী বেশী দোয়া করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দোয়া করবো তাও শিক্ষা দিয়েছেন । আল-কোরানে এসেছে, ‘‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’’ [সূরা বনি ইসরাঈলঃ ২৪]
‘‘হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’’ [সুরা ইবরাহীমঃ৪১]
এছাড়া আলস্নাহ রাববুল আলামীন পিতা-মাতার জন্য দোয়া করার বিশেষ নিয়ম শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না ’[সূরা নুহ: ২৮] ।
মা-বাবা এমন সন্তান রেখে যাবেন যারা তাদের জন্য দোয়া করবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে [সহিহ মুসলিম: ৪৩১০] মূলত: জানাজার নামাজ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া স্বরূপ।
দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সাদাকায়ে জারিয়াহ প্রদান করা : মা-বাবা বেচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেন নি বা বেচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদিসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃতু বরণ করেছেন। তাই কোন অছিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।’’ [সহিহ মুসলিম:২৩৭৩]
তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদাকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, (নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কোরান শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। ইত্যাদি।
মা-বাবার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন : মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোন মানতের সিয়াম কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোজা রাখবে’’ [সহিহ বুখারি:১৯৫২]।
অধিকাংশ আলেমগণ এ হাদীসটি শুধুমাত্র ওয়াজিব রোজা বা মানতের রোজার বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে নফল সিয়াম রাখার পক্ষে দলীল নাই।
হজ্জ বা উমরাহ করা : মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা উপকৃত হবে। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘‘ জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমণ করে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ কর। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না ? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী’’ [সহিহ বুখারি: ১৮৫২]
তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ্জ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ্জ-ওমরাহ করতে হবে।
মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানি করা : মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কুরবানীর জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো কর। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি যবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে কবুল কর”। এভাবে তিনি তা দ্বারা কুরবানী করলেন। [ সহিহ মুসলিম:৫২০৩]
মা-বাবার ওসিয়ত পূর্ণ করা : মা-বাবা শরীয়াহ সম্মত কোন ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের উপর দায়িত্ব। রাশীদ ইবন সুয়াইদ আসসাকাফী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেন না সে মু’মিনা । [সহিহ ইবন হিববান :১৮৯]
মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করা মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া,তাদেরকে হাদিয়া দেয়া। এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবান দীনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম: আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ’’ [সহিহ মুসলিম:৬৬৭৭]।
মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমলও আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও [সহিহ মুসলিম: ৬৪৩১]
মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখা : সন্তান তার মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ [সহিহ ইবন হিববান:৪৩২]
ঋণ পরিশোধ করা : মা-বাবার কোন ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা সন্তানদের উপর বিশেষভাবে কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। [সুনান ইবন মাজাহ:২৪১৩]
ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয় । হাদিসে আরো এসেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [নাসায়ী ৭/৩১৪; তাবরানী ফিল কাবীর ১৯/২৪৮; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/২৯]
কাফফারা আদায় করা : মা-বাবার কোন শপথের কাফফারা,ভুলকৃত হত্যাসহ কোন কাফফারা বাকী থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে। আল-কোরানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে সেটা ভিন্ন কথা) [ সূরা আন-নিসা:৯২]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘ যে ব্যক্তি কসম খেয়ে শপথ করার পর তার থেকে উত্তম কিছু করলেও তার কাফফারা অদায় করবে’’ [সহিহ মুসলিম: ৪৩৬০] । এ বিধান জীবিত ও মৃত সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। দুনিয়ার বুকে কেউ অন্যায় করলে তার কাফফারা দিতে হবে। অনুরূপভাবে কেউ অন্যায় করে মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা প্রদান করবেন।
ক্ষমা প্রার্থনা করা : মা-বাবার জন্য আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। সন্তান মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। হাদিসে বলা হয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মৃত্যুর পর কোন বান্দাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে হে আমার রব, আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কীভাবে এ আমল আসলো ? তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় এ মর্যাদা তুমি পেয়েছো’’ [আল-আদাবুল মুফরাদ:৩৬]।
মা-বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়ে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে এসেছে, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পার্শ্বে দাঁড়ালেন এবং বললেন ‘‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য ঈমানের উপর অবিচলতা ও দৃঢ়তা কামনা কর, কেননা এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে’’ [মুসনাদুল বাজ্জার :৪৪৫]।
তাই সুন্নাত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে কবরে দেয়ার পর তার কবরের পার্শ্বে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রশ্নোত্তর সহজ করে দেয়া, প্রশ্নোত্তর দিতে সমর্থ হওয়ার জন্য দোয়া করা।
মান্নত পূরণ করা : মা-বাবা কোন মান্নত করে গেলে সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, কোন মহিলা রোজা রাখার মান্নত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলে তিনি বলরেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন কর। [সহিহ ইবন হিববান:২৮০]
মা-বাবার ভাল কাজসমূহ জারী রাখা : মা-বাবা যেসব ভাল কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’। [সুনান আত তিরমিযি : ২৬৭০]
যে ব্যক্তির ইসলামের ভাল কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদেও সওয়াব থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহিহ মুসলিম:২৩৯৮]।
কবর জিয়ারত করা : সন্তান তার মা-বাবার কবর জিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, অত:পর মুহাম্মাদের মায়ের কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা কবর জিয়ারত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় [সুনান তিরমিযি :১০৫৪]।
জিয়ারত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় [সুনান তিরমিযি :১০৫৪]।
কবর যিয়ারত কোন দিনকে নির্দিষ্ট করে করা যাবে না। কবর জিয়ারত করার সময় বলবে, কবরবাসী মুমিন-মুসলিম আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক । নিশ্চয় আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আল্লাহর কাছে আপনাদের এবং আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। [সুনান ইবন মাজাহ : ১৫৪৭]
ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা : মা-বাবা কারো সাথে কোন ভাল কাজের ওয়াদা করে গেলে বা এমন ওয়াদা যা তারা বেচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কোরান মাজীদে বলা হয়েছে, আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। [ সূরা বনি ইসরাঈল:৩৪]
কোন গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা : মা-বাবা বেচে থাকতে কোন গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে। কেননা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এবং যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহিহ মুসলিম:৬৯৮০]।
মা-বাবার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া : মা-বাবা বেচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর জুলুম করে থাকলে বা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মা-বাবার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে। কেননা হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সুনান আত-তিরমিযি : ২৪২৮]
সুতরাং এ ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য তার হকদারদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া সন্তানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মা বাবার জন্য আমলগুলো করার তাওফীক দিন। আমীন!
No comments